কাকন রেজা : ফেসবুকে একটি ভিডিও ক্লিপ ভেসে বেড়াচ্ছে। রাজধানীর হোটেল রেডিসনের সামনে একটি দুর্ঘটনার দৃশ্যচিত্র এটি। দুটি বাসের যাত্রী উঠানোর প্রতিযোগিতায় বাসচাপায় ঘটনাস্থলে মারা গেছে দুজন; মতান্তরে তিনজন শিক্ষার্থী। সেই ভয়াবহ ভিডিওচিত্রটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।
দৃশ্যচিত্রটির ভয়াবহতার সঙ্গে যেটি মানুষের হৃদয় আর মস্তিষ্কে আঘাত করেছে, তা হলো আকুল কান্নার শব্দ। বুক ভেঙেচুরে হৃদয় নিংড়ানো কান্নার শব্দ। এই কান্না এখন প্রতিদিনের। সড়কে প্রতিদিন মানুষ মরছে, কোনো প্রতিকার নেই। সেদিন থামতে বলায় এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে পিষে দিয়ে গেছে একটি ট্রাক। ওই পরিবারটিতেও এখন কান্নার শব্দ।
কান্নার শব্দই এখন আমার স্বদেশ। চারদিকেই কান্নার শব্দ। রাস্তায় যখন-তখন মারা যাচ্ছে মানুষ, কোনো প্রতিকার নেই। গুলিতে, ছুরিতে, চাপাতিতে মরছে মানুষ, কোনো উচ্চবাচ্য নেই। ধর্ষণের শিকার নারীর প্রাণ নিচ্ছে ধর্ষকরা, কিংবা আত্মঘাতী হচ্ছে, কোনো হেরফের নেই।
জরিপ জানাচ্ছে, প্রতি বছর সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে ১২ হাজার মানুষ। রোড অথরিটি স্বীকার করছে পাঁচ হাজারের কথা। কিন্তু তারপরও থামছে না মৃত্যুর মিছিল।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গুলিতে, ছুরিতে, চাপাতিতে হত্যার কথা, মানবাধিকার হরণের কথা, কিন্তু কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। ভোট চলছে, অভিযোগ উঠতে ইসি বলছেন, শুনছি। এখানে সবাই শুধু শুনছেন। এটাকেও হয়তো ইতিবাচক বলা যায়, অন্তত তারা শুনছেন। না শুনলে কী হতো?
কোনো কিছুই হতো না। তবুও ভালো, তারা শুনছেন। হয়তো এত বেশি শুনতে হচ্ছে যে, কিছু করার সময়ই পাচ্ছেন না। হয়তো বিরক্তও হচ্ছেন এত বেশি অভিযোগে। হয়তো মনে মনে বলছেন, পাবলিকের খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, শুধু অভিযোগ, কাজ করুনগে যান। এখন সবকিছুই হয়তো এভাবে ‘হয়তো’তেই আটকে আছে।
দুই.
এর আগে মব জাস্টিসের কথা লিখেছিলাম। ব্যস্ত রাস্তায় গাড়িতে ধর্ষণরত একজনকে গণধোলাইয়ের কথায় উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম, বিচার যখন শুধু ডিলেইড অথবা ডিনাইড হয়, তখনই মব জাস্টিসের কারণ ঘটে। প্রতিকারহীনতা যখন সমাজ ব্যবস্থার অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তখন ‘লিঞ্চিং’ই সেই ব্যবস্থার প্রতিকার হয়ে দাঁড়ায়। ‘শুনছি’ বলাটা হলো প্রতিকারহীনতা নামক বারুদের সলতেয় আগুন লাগানো, আর বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকা।
যুক্তরাষ্ট্রে যখন মব জাস্টিসের দৌরাত্ম্যে অবাধ লিঞ্চিং চলছিল। নিগ্রোদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল অপরাধী আখ্যা দিয়ে। তখন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ইন্ডিয়ানার গভর্নরকে লিখেছিলেন অনেকটা এ রকম, ‘সুচিন্তাসম্পন্ন মানুষ অবশ্যই বিচারহীনতায় শঙ্কিত হবে। যারা বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে, তারা স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারে না।’
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কী মব জাস্টিসে শঙ্কিত হয়েছিলেন, নাকি শঙ্কিত হয়েছিলেন মব জাস্টিসের জনক বিচারহীনতায়, প্রশ্নটা সেখানেই।
গুলিতে বা গাড়িতে যেভাবেই হোক বা অজুহাত যাই হোক, মানুষ হত্যা হচ্ছে। যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতায় ফুটপাতের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে তিনটি বাচ্চাকে মেরে ফেলা হয়েছে, এটা পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। আর এমন হত্যাকাণ্ড আগেও ঘটেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পায়েলকে এমনিভাবে ড্রাইভার আর তার হেল্পার মিলে খুন করেছে। প্রথমে গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়েছে, পরে নিজেদের দোষ ঢাকতে পায়েলকে নদীতে ফেলে দিয়েছে ড্রাইভার ও হেলপার দুজনে। এটাও স্রেফ হত্যাকাণ্ড, নৃশংসতা। এমন হত্যাকাণ্ডের প্রতিকার হয় না বলেই মব জাস্টিসের কারণ ঘটে। যেমন: রেডিসনের সামনে শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিক্রিয়ায় বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে।
এই মব জাস্টিসের জন্য দায়ী হলো বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কিংবা বিচারহীনতা। মানুষ হত্যার বিচার হচ্ছে না বা দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলেই মানুষ গাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ভাঙচুর হচ্ছে। গুলি বা গাড়ি চাপা দিয়ে যেভাবেই হোক, হত্যা হলো অপরাধ। তার বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই উৎপত্তি ঘটে মব জাস্টিসের, যার পরিণতি লিঞ্চিং।
বিচারহীনতা ও লিঞ্চিং দুটোই অপরাধ। ক্রিমিনোলজি বলে, একটি অপরাধ থেকেই আরেকটি অপরাধের সূত্রপাত হয়। দ্বিতীয়টিকে রিভেঞ্জ, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ‘সোশ্যাল রিভেঞ্জ’ও বলা যেতে পারে।
সময় আছে এখনো, সোশ্যাল রিভেঞ্জের বিষয়টি মাথায় রেখে দায়িত্বশীলদের কাজ করতে হবে। প্রথম অপরাধটির বিচার হলে এবং বন্ধ হলে, মব জাস্টিসও বন্ধ হবে। না হলে ‘লিঞ্চিং’ কোনো না কোনো সময় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, দেবালয়ে আগুন লাগলে দেবতার বিগ্রহও রক্ষা পায় না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
(লেখাটি প্রিয়.কম থেকে নেওয়া)
আপনার মতামত লিখুন :