রুমানা ইসলাম খান : খান সাহেব ধানমন্ডিবাসী। সে জন্ম থেকে ঐ এলাকায় বড়। আবাহনী মাঠ ছিল তার খেলার মাঠ। শেখ কামাল তাকে খুব আদর করতো, তাই তার নাদুস-নুদুস গোলগাল চেহেরার জন্য জুনিয়র থাকায় শেখ রাসেল তাকে খেলায় নিতো না। বলতো- তুই বাদ, যা ভাগ। তৎকালিন প্রেসিডেন্ট এর বড় ছেলের আঙুল ধরে সে প্রায় তাদের বাসায় যেতো এবং সেখানে মজার মজার নাস্তাও খেতো।
দারুন একটা লোক ছিলো- শেখ কামাল। এটা ছিল তার শিশুকালের স্মৃতি এবং গর্বও। এগুলো আমি বসে বসে শুনি আর হাই তুলি। বড় মানুষের পিছে আমি কি শৈশবেও হাটতাম..? মনে নেই তা। মূলত যারা ধান্ডমন্ডিবাসী তাদের অনেককেই সে শৈশব থেকে চিনে। কথায় কথায় বলতো- তাদের এলাকা হেন.... তাদের এলাকা তেন। বিয়ের পর আমি গিয়ে উঠলাম তাদের এলাকায়। হায় এ কেমন এলাকা ! বিশাল বিশাল গলি গুলো সব শান্ত। কোন ছোটাছুটি চেঁচামেচি নাই। জায়গায় জায়গায় ফেরিওয়ালা নাই। সকালে দু-একটা ডাক কানে এলেও দুপুরের পর থেকে সব নিরব। কেউ কাউকে পুছেও না। মেয়েগুলি হাই হিল পরে গট গট করে হেটে গাড়িতে বসে। ছেলেগুলো কেমন জানি হুসহাস করে বাইক নিয়ে দৌঁড়ায়। দেখতেও সব সেই রকম। একদম মাক্ষন-মালাই। তাদের অনেকরই স্কিন পাতলা ঠোঁট, কালার করা চুল, পড়নে দামি পোশাক। ওদের মাঝে আমি বড্ড এলো মেলো , চুল খোলা পাগলি, টিপ পড়া ম্যাতরানি, শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ, পায়ে কলাপুরী, হাতে আজগুবি সব আইম্যান.......নাহ টোটাল মিলে বেমানান।
২৭ নাম্বার নামে এক জায়গা আছে, দুনিয়ার খাবার দোকান। দোকানে ঢুকলেই মনে হয় সেন্ডেল খুলে হাতে নিয়ে নেই। তোমরা সন্ধ্যায় পুরি খাও না? খাই। তো কই পুরির দোকান। আছেতো! রায়ের বাজারের দিকে পুরির দোকান আছে। আমি আনবো নে।
লাগবেনা । এক টাকা দামের পুরির জন্য দশ টাকা রিক্সাভাড়া দেয়ার কি দরকার। নান খাও, কাবাব খাও, ইন্ডিয়ান ফুড আছে দেখো খুব মজা। এসব খাও। দেখো কত সুন্দর মোবাইল রেস্টুরেন্ট সাজানো। সব ইন্ডিয়ান ফুড বেঁচে এখানে। চলো স্যুপ খেয়ে আসি।
সন্ধ্যায় রাতের খানা খাবো?
কেবল স্যুপ খাবো। আর কিছু না! এরা খালি স্যুপ খেতে দেবে? অন্য কিছু অর্ডার না করলে যদি বেঁধে রাখে।
কি সব কথা এগুলো। তুমি না ঢাকার মেয়ে?
হ্যাঁ। তবে এই ঢাকার নয়। এটা বিত্তবানদের এরিয়া। আমরা মূল ঢাকার মানুষ। যেখানে একই রাস্তায় চাইনিজ এর দোকান আবার পুরির দোকান দুটোই আছে। যেখানে গলিগুলো সুড়– থাকলেও পোলাপান তাতেই ক্রিকেট খেলে দু‘চার বাড়ির জানালার গ্লাস ভাঙ্গে। যেখানে হকার আর ফেরিওয়ালা সারাদিন হাকডাক করে। যেখানে ঘন্টায় ঘন্টায় দরজার কড়া নেড়ে পরিচিত ভঙ্গিতে ভিক্ষুক ভিক্ষা চায়।
যেখানে দুপুর হলেই মায়েরা মেঝেতে বালিস পেতে শোয়। আর তার বাচ্চারা মায়ের শরীরটাকে বর্ডার লাইন বানিয়ে দুদিক থেকে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে। তাতে মায়ের ঘুমের কোন ব্যাঘাত ঘটেও না। যেখানে কিশোরী ছাদে উড়ার বাহানা খুঁজে পাশের বাড়ি ছেলেটাকে এক নজর দেখবে বলে। যেখানে বৃস্টি হলে রাস্তায় ছোট ছোট পোলাপান নাচা-নাচি করে বৃষ্টিতে ভেজে। যেখানে পথচারী পান দোকানের প্লাস্টিকের শেডে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ছাতির মাথা দিয়ে খোঁচা দেয়। আর সেই পানিতে পা এর কাদা ধোয়।
আমি সেই ঢাকার মেয়ে। টিপিকাল মধ্যবিত্ত।
দেখো আমিও মধ্যবিত্ত।
তবুও তোমার গায়ে সরা সরা গন্ধ।
স্বাভাবিক। এলাকাটাই এমন। এসব দেখেই অভস্ত।
আমি এসবে অভস্ত হতে চাই না। ফেরিওলার সাথে দরদাম করে সবজি কিনবো। সন্ধ্যা ভাইয়েরা দৌঁড়ে হেটেল থেকে পুরি কিনে আনবে। দুপুরের সালমানের সপ্ন রেখে ঘুম ঘুম চোখে ফকিরকে ভিক্ষা দিবো, সাথে শাসানি আবার যদি দুপুরে আসোস তো দেখিস কি করি। আমি ঐ জীবনে অভস্ত এটা আমার জীবন নয় গো।
উফফফ..........!
শাশুড়ী গত হবার দু মাসের মধ্যেই আমি আমার এলাকায় বাসা ভাড়া করে চলে আসি। মাত্র দু বছর ছিলাম ঐ এরিয়ায়। না আমি তাদের মত হতে পারিনি। আজ ১৬ বছর খান সাহেব আমাদের এরিয়ায় থাকে। না সেও আমাদের মত হতে পারেনি। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে বেলা করে বের হয়। সবাই তাকে চেনে। সে কাউকে চেনে না। জামাই সে এখনও আমাদের পাড়ায়। কেও তাই তাকে ঘাটায়ও না।
সম্পাদনা: সিদ্ধার্থ দে
আপনার মতামত লিখুন :