শিরোনাম
◈ মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে ঢাকা ফিরছিলেন রফিক, পথে প্রাণ গেল সবার ◈ স্থায়ী জামিন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছি ড. ইউনূসের আইনজীবী ◈ উপজেলার ভোটে এমপি-মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপ না করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ : ওবায়দুল কাদের  ◈ শ্রম আইন লঙ্ঘন: ড. ইউনূসসহ ৪ জনের জামিন ২৩ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি ◈ ময়মনসিংহে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ২৬ ◈ ফরিদপুরে বাস-পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত বেড়ে ১৩  ◈ ইরানের হামলার জবাব দেবে ইসরায়েল: সেনাপ্রধান ◈ সৌদিতে কোরবানি ঈদের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা ◈ কৃষি খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে তিন  বছরে সাড়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ◈ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.১ শতাংশ: এডিবি

প্রকাশিত : ১৮ জুলাই, ২০১৮, ০৬:৩৫ সকাল
আপডেট : ১৮ জুলাই, ২০১৮, ০৬:৩৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

স্বাধীন দেশ মুক্তিযোদ্ধা মোক্তারকে সইতে পারলো না

কামরুল হাসান ভুঁইয়া: মোক্তার পেশায় চোর। বাড়ি ঢাকা-নারায়নগন্জ (পুরানো) রাস্তার পাশে — শ্যামপুর। ২৫/২৬ বছরের যুবক মোক্তার। পেশীবহুল পেটানো শরীর। সব সময়ের, সব লগনের তার একই পোষাক-সাদা লুঙ্গি আর দু’পাশে পকেটসহ সাদা ফুলহাতা সার্ট। কমলাপুর রেলস্টেশনে অপেক্ষমাণ মালগাড়ি কেটে মাল চুরি করে বিক্রি করে মোক্তার। এ বিশেষ দক্ষতার সুন্দর ইংরেজি নাম আছে — ডধমড়হ ইৎবধশবৎ। বাঁ হাতে একটা বড় রুপার আংটি, মুখে পান আর ঠোঁটে সিগারেট — সব নিয়ে মোক্তার ছিল দশজনের চেয়ে আলাদা।
মে মাসে ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন হায়দারের প্রশিক্ষণ সহায়তায় ইস্পাত কঠিন চিত্তের কিছু তরুণ দিয়ে তৈরি করেন ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। ঢাকা শহরে পাকিস্তানি সেনাদের নাস্তনাবুদ করা ছিল এই ছেলেদের দায়িত্ব। মে মাসেই ক্র্যাক প্লাটুনের প্রথম দলটি ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। মায়া, আলম, বদি, স্বপন, সাইদ, সিরাজ, গাজিদের সঙ্গে যোগ দেয় জুরাইনের হানিফ এবং শ্যামপুরের আমাদের মোক্তার। অস্ত্র সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই মোক্তারের, নেই যুদ্ধের সামান্যতম শিক্ষাও। তারপরও মোক্তার এক অসীম সাহসী স্বেচছাসৈনিক।
ফতেহ আলী চৌধুরী মেলাঘর আগস্ট মাসে মোক্তারকে পাঠালো তার ৩০, হাটখোলা রোডের বাসায়। এতোদিনে মোক্তার ফতেহ আলীর বাবা, মা এবং ভাইবোনদের সঙ্গেও ঘনিষ্ট হয়ে গেছে। ফতেহ আলীর বড় ভাই সাহাদত চৌধুরী এবং ছোট ভাই মোর্শেদ চৌধুরীও ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। সে নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। বাবা অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ আব্দুল হক চৌধুরী। মা জাহানারা সংসারের কেন্দ্রীয় চরিত্র। মোক্তারকে স্নেহ করেন নিজ সন্তানের মতো। মোক্তার এসেছে ফতেহ আলীর ছোট দুই বোনকে মেলাঘর নিয়ে যেতে। ঝিমলি পড়ে কলেজে, ডানা দশম শ্রণীতে। মা জাহানারা বললেন, ‘এ বয়সের মেয়ে যদি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে’? মোক্তার কথা মাটিতে পড়তে দিল না। কোমড় থেকে পিস্তল বের করে বললো, ‘আম্মা, জীবিত না আমি থাকতে’। মোক্তার জীবিত থাকতে তার বোনেরা আপদে পড়তে পারে না। এ দৃশ্যের পর মা জাহানারা মেয়েদের আর মোক্তারের হেফাজতে দিতে সাহস পাননি।
মায়া, আলম, ফতেহ, গাজী, মানুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই সবার আপন উঠেছে আমাদের মোক্তার। সে সবার প্রহরী। আলমদের ১/৩, দিলু রোডের বাসায়ও অবাধ যতায়াত মোক্তারের। আলমের পরিবারের সঙ্গেও সে ঘনিষ্ঠ। জনযুদ্ধের ঐ এক বৈশিষ্ট। বিত্ত আর বৈভবে বড় হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর অক্ষর পরিচিতিহীন মোক্তারেরা একই সমতটে একাকার হয়ে যায়। স্বাধীন দেশ বদলে দিয়েছে মোক্তারকে। হাতে কাপড় বোনার একটা তাঁত কিনেছে। নিজের হাতে বোনা প্রথম লুঙ্গিটা নিয়ে এসেছে ফতেহ আলীর জন্য। পরে আরো তিনটা তাঁত কেনে মোক্তার। সুতা বাজারে নেই, কালোবাজারে আছে। সুতার পারমিট নিয়ে টাকার পাহাড় বানাচ্ছে লোকজন। মোক্তার প্রতিবাদ করে। তারা মোক্তারের নামে মিথ্যা ডাকাতির মামলা দেয়। বাহাত্তর সালের নভেম্বর মাসে পুলিশ বুকে গুলি করে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে মোক্তারকে। মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশ মোক্তারকে ভর্তি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মোক্তারের আহত হবার সংবাদে গোটা ঢাকা শহরের মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে আসে। আসেন মা জাহানারা, বোন ডানা ও ঝিমলি। আসেন ঢাকা শহরের মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসক ডা.আজিজুর রহমান। হাবিবুল আলম আসে তার বোন রেশমা এবং শাহনাজেকে নিয়ে। এক ডাকাতকে দেখতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে উপচে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট। তারা এসেছে তাদের রণাঙ্গনের এক অকুতোভয় সহযোদ্ধাকে দেখতে। মোক্তারের প্রহরার নিয়োজিত পুলিশ হকচকিয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করে,’আপনারা একটা ডাকাত দেখতে এসেছেন কেন’? প্রশ্নটি কী করে পৌছলো মা জাহানারার কানে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি গর্জে উঠলেন, ‘খবরদার! তোমরা আর কক্ষনো ওকে ও নামে ডাকবে না। তোমরা কি জানো ও কতো সাহসী একজন মুক্তিযোদ্ধা? ও আমাদেরই একজন’। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে মা জাহানারা বেরিয়ে আসছেন। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। কোন জগতে আছে সন্তানের মৃত্যুতে মা কাঁদেনি?
মা জাহানারার উত্তেজিত উচ্চারণ মুমূর্ষ মোক্তার শুনেছিল কি না আমরা জানি না। সে রাতটা কাঁটেনি মোক্তারের। এক বুক অভিমান নিয়ে কাউকে কিছু না বলেই নীরবে চলে গেল মোক্তার। একটা পরাধীন দেশ অসাধু মোক্তারকে সইতে পারলো, স্বাধীন দেশ মুক্তিযোদ্ধা মোক্তারকে সইতে পারলো না। হা স্বাধীনতা !
( এই পোস্টটি পুরানো, সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালের। পোস্টটি পড়ে আমার বন্ধু তালিকায় নেই তেমন একজন মেয়ে পলা মন্তব্যে লিখলো যে, মোক্তার এবং দুই বোন ডানা ও ঝিমলির সেই কাহিনী শুনিয়ে শুনিয়ে তার মা শিশুকাল তাদের ভাত তুলে খাওয়াতেন। মন্তব্য পড়ে আমি শিহরিত। শেষ বাক্যে লিখেছে, ‘ঝিমলি আমার মা’।
মাঝে মাঝে কাঁদতেও ভালো লাগে।
পরিচিতি: চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ/ ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়