শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ২১ জুন, ২০১৮, ০৫:৫৪ সকাল
আপডেট : ২১ জুন, ২০১৮, ০৫:৫৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ভারত ফ্যাক্টর এবং বিএনপির তীর্থযাত্রা

মহিউদ্দিন আহমদ : রোজার মাসে রাজনীতি ছিল নিরুত্তাপ। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য, চিকিৎসা এবং হাসপাতাল নিয়ে কথা চালাচালি ছাড়া তেমন কিছু দৃশ্যমান হয়নি। এর মধ্যেই ঘটে গেল অন্য রকম এক তীর্থযাত্রা। বিএনপির তিনজন প্রতিনিধি দিল্লির দরবারে গিয়েছিলেন। কথা বলেছেন একাধিক ‘থিংকট্যাংকের’ সঙ্গে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে এবং আড়ালে-আবডালে নানান কথাবার্তা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কি কৌশল পাল্টাচ্ছে? বিএনপি কি তার সনাতন ধারা থেকে সরে এসেছে? বিএনপির কি মতিভ্রম হয়েছে? ইত্যাদি। আকলমন্দ যাঁরা তাঁরা জানেন, সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আছে এক ইতালীয় কূটনীতিক-রাজনীতিকের বইয়ে। বইয়ের নাম দ্য প্রিন্স। লেখকের নাম ম্যাকিয়াভেলি।

এটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয় যে আমাদের দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সরকার গঠন নিয়ে বিদেশিদের কারও কারও বেশ আগ্রহ আছে, আছে ‘স্টেক’। ভারত ও পাকিস্তান তো উল্লেখযোগ্য চরিত্র। এসব দেশের সরকার, প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থা নানাভাবে কাজ করে। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। ১৯৯১ সাল থেকেই এ উপদ্রব শুরু হয়েছে। যে ধারণাটি সাধারণভাবে আলোচিত তা হচ্ছে ইসলামাবাদের সহানুভূতি রয়েছে বিএনপির দিকে, আর দিল্লির পছন্দের দল হলো আওয়ামী লীগ।

অভিন্ন সীমান্ত থাকার কারণে এবং রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার সুবাদে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব এবং তা প্রয়োগের সুযোগ অন্য প্রতিবেশীদের তুলনায় বেশি। ভারতের বদলে প্রতিবেশী যদি হতো রাশিয়া কিংবা চীন, তাহলে পরিস্থিতি হতো অন্য রকম। ইতিহাস এবং ভূগোল, দুটোই ভারতকে সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে কয়েক দিন যে দৌড়ঝাঁপ করেছেন, গণমাধ্যমে আমরা সেটা বিলক্ষণ দেখেছি। বিএনপির সব আপত্তি, বাধা ও প্রতিরোধ উপেক্ষা করে নির্বাচনটি করিয়ে নেওয়া হলো। ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার কয়েকটি দেশ প্রথম কয়েক মাস গাঁইগুঁই করলেও পরে থেমে গিয়েছিল। মহাজোট সরকার বিনা বাধায় পুরো মেয়াদ পার করে দিচ্ছে। এটি বিএনপিকে করেছে হতোদ্যম ও কোণঠাসা এবং আওয়ামী লীগকে করেছে আরও আত্মবিশ্বাসী ও একরোখা। বিএনপির উপলব্ধি হলো আমাদের কৌশল মাঠে মারা গেল। ৫ জানুয়ারি আরেকটি ১৫ ফেব্রুয়ারি হলো না। আওয়ামী লীগের উপলব্ধি হলো আমরাই পারি। এখন সবাই তাকাচ্ছেন সামনের দিকে, আগামী জাতীয় নির্বাচনটি কেমন হবে, কিংবা কীভাবে হবে। এ দেশে সংগত কারণেই সংশয়বাদীদের সংখ্যা নেহাতই কম নয়।

আওয়ামী লীগের সভাপতি আবার প্রধানমন্ত্রীও কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে খোলামেলাভাবেই বলেছেন, ভারতকে আমি যা দিয়েছি, তা তারা চিরদিন মনে রাখবে। তিনি এ কথাও বলতে ভোলেননি যে তিনি কোনো প্রতিদানের আশা করেন না। ভারত ভাবতেই পারে, আমরা তো এমনিতেই অনেক কিছু পাচ্ছি, ভবিষ্যতেও পাব, এই সুযোগ কে ছাড়ে!

বিএনপির নানা সমস্যা। তারা তো ঘরের মধ্যে ঢুকতেই পারছে না। বাইরে থেকেই চেঁচামেচি করছে। বলছে, ওই ঘর অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে। আসলে কথা হলো ঘর যাঁর দখলে, তিনিই মালিক। রাজনীতির এই এক সরল সূত্র। অনেকেই এটা বুঝতে চান না। তাঁরা কেতাব ঘেঁটে নানান নীতিকথা আওড়ান। ঘরের দখল একবার পেলে নীতি নির্বাসনে যায়।

বিএনপি চড়া মাশুল দিয়ে বুঝেছে, ভারতকে সঙ্গে না পাক, নিদেনপক্ষে ‘নিউট্রালাইজ’ করতে পারলে ভবিষ্যৎ রীতিমতো ফরসা। এ উদ্দেশ্যেই বিএনপির তিন প্রতিনিধির সাম্প্রতিক তীর্থযাত্রা। এ যাত্রায় বরফ কতটুকু গলেছে তা নিয়ে তাদের দলের মধ্যে হিসাব-নিকাশ হচ্ছে নিশ্চয়ই। ধারণা করি, এটি ছিল তাদের একটি প্রাথমিক ‘রেকি’। শিগগিরই তাদের আরেকটি প্রতিনিধিদল দিল্লি সফরে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এর আগেও এ রকম যাওয়া-আসা হয়েছে, চলেছে, হয়তো আরও চলবে।

দেশে বিএনপির একটি বড় সমর্থক গোষ্ঠী আছে। দল যতই অগোছালো হয়ে যাক না কেন, তাদের ভোটাররা এই দলকে ছেড়ে যাবেন বলে মনে হয় না। অর্থাৎ যাঁরা যেসব কারণে এত দিন বিএনপিকে সমর্থন করে এসেছেন, তাঁরা সহসা বিএনপির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবেন, এটা ভাবার অবকাশ খুব কম। যাঁরা আওয়ামী লীগ করেন না বা আওয়ামী লীগের ওপর নানা কারণে ক্ষিপ্ত, তাঁদের তো যাওয়ার কিংবা ভরসার একটা জায়গা থাকতে হবে। এত দিন বিএনপি সে কাজটাই করে এসেছিল।

বিএনপি তো আওয়ামী লীগের কট্টর বিরোধী। বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী এবং ইসলামবিদ্বেষী। অর্থাৎ এ দেশে ‘ভারতবিরোধী’ ও ‘ইসলাম পসন্দ’ রাজনীতির যে ধারাটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল বলে একসময় মনে হয়েছিল, তা ছিল ভুল। ওই ধারাটি আড়ালে চলে গিয়েছিল। গত পাঁচ দশকে এটি ক্রমে ক্রমে স্ফীত হয়েছে, ডালপালা মেলেছে। বিএনপি মনে করে তথাকথিত সেক্যুলার রাজনীতির নামে আওয়ামী লীগ দেশটিকে ভারতের স্বার্থের কাছে জলাঞ্জলি দিয়েছে। এ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য বিএনপির ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতি ছাড়া বিকল্প নেই।

বিএনপি নেতাদের দিল্লি সফরের পর দলের কেউ কেউ বলছেন আমরা এত দিন ভুল করেছি বা আমরা তো ভারতবিরোধী নই। মুশকিল হলো জনগণকে যদি তাঁরা একবার গেলাতে পারেন যে তাঁরা ভারতের বন্ধু, এমনকি আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় বন্ধু, তাহলে তাঁদের বিশাল ভারতবিরোধী ভোটব্যাংকের কী হবে? তাঁরা তাহলে বিএনপিকে সমর্থন দেবেন কেন? এখানেই বিএনপির সংকট।

একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, সবাই যাঁর যাঁর পছন্দের মার্কায় ভোট দিতে পারলে এবং ভোটের বাক্স লুট না হলে বিএনপি আশা করে যে তারা নির্বাচনে জিতবে। এখন অবশ্য মনে হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আশা সবাই ছেড়ে দিয়েছেন। একটা ভালো নির্বাচন হলে ভারত এল কি গেল তাতে কী যায় আসে? খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ কারচুপি হয়েছে’। নির্বাচন কমিশন খুলনার নির্বাচন নিয়ে খুবই খুশি। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা বলছেন, খুলনার মতোই হবে জাতীয় নির্বাচন।

দেশকে তরক্কির পথে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে হলে আওয়ামী লীগকে আবারও দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে হবে বলে আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ ও নির্ভরযোগ্য উপদেষ্টা কয়েক মাস আগে মন্তব্য করেছিলেন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে উঠে আসা একজন সদস্য সংসদ অধিবেশনেই বলেছেন, শেখ হাসিনাকে আজীবন প্রধানমন্ত্রী রাখতে হবে। বিএনপি চাচ্ছে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সব অংশগ্রহণকারীর জন্য সমান সুযোগ। নাগরিক সমাজ তো অনেক দিন থেকেই একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের ব্যাপারে উচ্চকিত। এদিকে শোনা যাচ্ছে বিএনপি নির্বাচনে আসবে, আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করবে। শ্যাম আর কুল দুই-ই থাকবে। কীভাবে এই ফর্মুলার বাস্তবায়ন হবে জানি না। ‘গসাগু’র নিয়ম মেনে বিএনপির পাতে কতটুকু দিলে তারা তুষ্ট হয়ে নির্বাচনে আসবে, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা হচ্ছে। এ ধরনের একটি মীমাংসা না হলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় আরও বাড়তে পারে।

আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে, সেটি জানতে হলে দিল্লির মন বোঝা খুবই জরুরি। বিএনপি এখন সে চেষ্টায় আছে। তারা কামিয়াব হবে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। হিমালয় থেকে উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করবে অক্টোবর-নভেম্বর থেকে। দেখা যাক।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
সূত্র : প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়