শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ১৮ জুন, ২০১৮, ০৯:৫৩ সকাল
আপডেট : ১৮ জুন, ২০১৮, ০৯:৫৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

নৌকায় করে এলাকা ছাড়ছেন পানিবন্দিরা

ডেস্ক রিপোর্ট : কুলাউড়ার ১৩টির মধ্যে এখন সাতটি ইউনিয়ন বন্যা আক্রান্ত। রোববার এর মধ্যে সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত হাজীপুর ও পার্শ্ববর্তী টিলাগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাড়িঘরে এখনো পাঁচ-ছয় ফুট পানি। অনেকের কাঁচা ঘরের চালা, বেড়া ধসে পড়েছে। হাজীপুরের বারইগ্রামে মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধের ভাঙন দিয়ে শোঁ শোঁ করে পানি ঢুকছে। পানির তোড়ে ভেঙে পড়েছে কুণিমোড়া-কাউকাপন বাজার পাকা সড়ক।

কুলাউড়া-শমশেরনগর সড়কের সালন ও কুণিমোড়া এলাকা তিন-চার ফুট পানির নিচে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে নৌকায় করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে মনু নদের পানি কমতে থাকলেও নতুন করে শহরের মোস্তফাপুর রোড, পাগুলিয়া রোড, ঢাকা বাসস্ট্যান্ড, সদর হাসপাতালের সামনে দিয়ে পানি বাড়ছে। ফলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে বাসাবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিচ্ছেন। এর আগে কুসুমবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বিকেল পর্যন্ত গরু-বাছুরসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নিয়ে ভ্যান ও নৌকায় করে এলাকা ছাড়ছেন পানিবন্দিরা।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের বন্যা আক্রান্ত উত্তর পলকি গ্রাম। পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় ঝুঁকি সয়ে বাড়িতেই ছিলেন ছমরু মিয়া। ঘরের মালপত্র রেখে যাবেন কোথায়! কিন্তু শেষমেশ কাঁচা ঘরটি আর রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আজ রোববার সকালেই ঘরটি ধসে পড়ে। তাই বাধ্য হয়েই কোমরপানি ভেঙে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাকা সড়কের কাছে ওঠেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে ছমরু বললেন, ‘ভাই, ঘরটা আর টিকাইতাম পারলাম না। অখন কই যাইতাম!’ মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের উত্তর পলকি গ্রামে তাঁর বাড়ি।

হাজীপুরের রজনপুর গ্রামে মন্নান মিয়ার ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। খাটের ওপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আছেন। খাটের এক পাশে টিন দিয়ে তৈরি চুলায় রান্নার কাজ চলছে। মন্নান বলেন, ‘শুক্রবার রাইতে পানি কমতে ধরছিল। কাইল (শনিবার) দুপুর থাকি আবার বাড়া শুরু হইছে। কয় দিন যে অবস্থার মাঝে থাকমু একমাত্র ওপরওয়ালাই জানেন।’ বারইগ্রামের রিনা বেগম (৪০) বলেন, ‘ঘর ভাসাই নিছে। কিচ্ছু বাইর করতাম পারছি না। আরেক বাড়িত গিয়া আশ্রয় নিছি।’

বারইগ্রামে বন্যাদুর্গত মানুষকে ত্রাণ দিচ্ছিলেন ‘শুভেচ্ছা ক্লাব’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের কয়েকজন সদস্য। তাঁদের কেউ সরকারি, কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কেউ কেউ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন।

সংগঠনটির সভাপতি পুলকেশ নাগ বলেন, ‘সংগঠনের সদস্যরা চাঁদা তুলে ত্রাণের ব্যবস্থা করেছি। তিন দিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে শুকনো খাবার দিচ্ছি। কাল (সোমবার) স্থানীয় একজন পল্লি চিকিৎসককে নিয়ে দুর্গত এলাকায় গিয়ে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে।’ ‘নির্ঝর ক্লাব’ নামের স্থানীয় আরেকটি সংগঠনের সদস্যরা উত্তর পলকি গ্রামে দুর্গত মানুষকে ত্রাণ দেন।

হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুল লতিফ চৌধরী তাঁর দোতলা বাড়ি দেখিয়ে বলেন, এর ঠিক পেছনে মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধে ১২ জুন বিকেলে ভাঙন দেখা দেয়। পানির তোড়ে পাকা সীমানাপ্রাচীরসহ বাড়ির ভেতর থাকা দুটি ট্রাক্টর ও একটি মাইক্রোবাস ভেসে গেছে। জীবন বাঁচাতে শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। আবদুল লতিফ চৌধুরী বলেন, তাঁর এলাকাতেই অন্তত ৫০০ কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এক হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী।

হাজীপুর ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল বাছিত বলেন, ৪২টি গ্রাম বন্যা আক্রান্ত। পানি নামার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কাঁচা ঘর, রাস্তাঘাট আর আউশ ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারিভাবে ১০ মেট্রিক টন চাল পাওয়া গেছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

কুলাউড়ার ইউএনও চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বী বলেন, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ হিসেবে ১০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ দেড় লাখ টাকা পাওয়া গেছে। ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৮০ পরিবার উঠেছে। প্রতিদিন সবাইকে খিচুড়ি ও শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। কেউ না খেয়ে নেই।

বারের বন্যার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ আবার পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) দায়ী করছেন। কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আ স ম কামরুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় অনেকবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বলেছি, মনু নদের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো ভালোভাবে মেরামত করতে। কিন্তু তারা কিছু স্থানে দায়সারা কাজ করে গেছে। ফলস্বরূপ এখন বাঁধ ভাঙল।’

তবে পাউবোর কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা অর্থ বরাদ্দ কম পেয়েছেন। আর তাই কাজ আশানুরূপ হয়নি। পাউবোর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, গত বছর অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও ভাঙনকবলিত বাঁধ মেরামতে অর্থ বরাদ্দ কম পাওয়া যায়। সেটা দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে কাজ করিয়েছেন।

রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, কুলাউড়ায় মনু নদে এখন ডেঞ্জার লেবেলের নীচে পানি রয়েছে। কুশিয়ারা নদী পানি বেশি টানতে পারছে না। তাই পানি ধীরে ধীরে কমছে।’

এদিকে মনু নদের পানি কমতে থাকলেও নতুন করে শহরের মোস্তফাপুর রোড, পাগুলিয়া রোড, ঢাকা বাসস্ট্যান্ড, সদর হাসপাতালের সামনে দিয়ে পানি বাড়ছে। ফলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে বাসাবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিচ্ছেন। এর আগে কুসুমবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বিকেল পর্যন্ত গরু-বাছুরসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নিয়ে ভ্যান ও নৌকায় করে এলাকা ছাড়ছেন পানিবন্দিরা।

মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আমজাদ মিয়া বলেন, আমরা সারাদিন অনেকটা নিশ্চিন্তে ছিলাম যে- পানি হাওরের দিকে চলে যাবে। কিন্তু বিকেল হতেই পানি শহরমুখী হয়েছে। এখন ঘরে হাঁটুজল দেখা দিয়েছে। তাই মালামাল মিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছি।

বন্যার পানিতে রাস্তা ডুবে যাওয়ায় মৌলভীবাজার জেলা শহরের সঙ্গে সিলেট বিভাগীয় শহর ও জেলার ৪টি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। অতিরিক্ত পানি প্রবাহ ও স্রোত থাকায় মৌলভীবাজার-সিলেট রোডের বড়হাট এলাকায় গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে শুক্রবার থেকে মৌলভীবাজার কুলাউড়া সড়কের রাজনগর উপজেলার কদমহাটা এলাকায় একই কারণে রাস্তা বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্লাবিত মৌলভীবাজার শহরের একাংশে সীমাহীন দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে মনু নদের পানি কমতে শুরু করলেও শহর ও শহরতলীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ফলে দুর্ভোগ ও আতঙ্ক বেড়েছে শহরের বিভিন্ন এলাকায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, রোববার (১৭ জুন) রাত ১০টা পর্যন্ত মনু নদের পানি কমে গিয়ে বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। যা গতকাল পর্যন্ত বিপদসীমার সর্বোচ্চ ১৮০ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হয়েছিল। এছাড়া প্রতি ঘণ্টায় ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার পানি কমছে বলে জানিয়েছে পাউবো।

তবে মনু নদের পানি দ্রুত কমতে থাকলেও বাঁধ ভেঙে শহরের একাংশে প্রবাহিত পানি এখনো নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করছে। ফলে নতুন করে পানিবন্দি হচ্ছে অনেক পরিবার।

ইতোমধ্যে পৌরসভার বড়হাট, বারইকোনা, যোগীডর, ধরকাপন, বড়কাপন, গোবিন্দ্রশ্রী, খিদুরসহ পৌরসভার ৬,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড পানিবন্দি হয়েছে। এছাড়া সদর উপজেলার মোস্তফাপুর, আমতৈল, কনকপুর, ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

জানা যায়, শুক্রবার (১৬ জুন) মধ্য রাতে পৌরসভার বারইকোনা এলাকায় মনু’র প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে শহরের বড়হাট ও কুসুমবাগ এলাকা প্লাবিত হয়। এর পর সে পানি পৌরসভার ৩টি ওয়ার্ড ও সদর উপজেলার ৩টি ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে। এতে শহর ও শহরতলীর বাসাবাড়ি প্রায় ৫ ফুট পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে ঘর বাড়ি ছেড়ে ঢলের পানি ঠেলে মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেন। অধিক প্লাবনে আক্রান্ত হয় প্রায় ৫ হাজারের বেশি পরিবার।

বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিকেলে প্রেস ব্রিফিং করে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, শহরে যারা পানিবন্দি হয়েছিলেন তাদের নৌকা ও স্পিডবোট দিয়ে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করেছে। আমরা তাদের জন্য ৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দিয়েছি। সেখানে এনে তাদের শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে। রোববার থেকে সরকারি ত্রাণ দেয়া হবে।
সূত্র : পরিবর্তন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়