শিরোনাম
◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী  ◈ সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম নালিশের রাজনীতি করছে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের ◈ বুশরা বিবিকে ‘টয়লেট ক্লিনার’ মেশানো খাবার খাওয়ানোর অভিযোগ ইমরানের ◈ গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল ◈ প্রার্থী নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, হস্তক্ষেপ করবো না: পলক ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী ◈ অ্যাননটেক্সকে জনতা ব্যাংকের সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের

প্রকাশিত : ১৪ জুন, ২০১৮, ০৩:০১ রাত
আপডেট : ১৪ জুন, ২০১৮, ০৩:০১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘বন্দুক দিয়ে মাদক নির্মূল অসম্ভব’

ড. মীজানুর রহমান : মাদক বিরোধী যেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে এটা দিয়ে মাদক নির্মূল করা অসম্ভব। কেবল মাত্র সাময়িক দমন করা সম্ভব । এতে করে যা হবে তা হল আপাতত কিছুদিন মাদকের ব্যবহার কমবে আর দাম বাড়বে। এছাড়া তেমন কিছু হবে না। কারণ মাদকের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ নতুন কিছু নয়। কলম্বিয়া, মেক্সিকোতে বিশ-ত্রিশ বছর ধরে এই যুদ্ধ চলেছে। আমেরিকা এই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সত্তরের দশকে। যদিও বারাক ওবামা এসে বলেছিলেন যে এটাকে ‘যুদ্ধ’ বলবনা আমরা, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে আবার বলছেন সেই ‘ মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ‘। তাই এটা নতুন কিছু নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে পৃথিবীর যেখানেই এই অভিযান চালনা করা হয়েছে সেখানে মাদকের বিস্তার সাময়িক ভাবে কিছুটা দমন করা গিয়েছে কিন্তু শেষপর্যন্ত তেমন বড় কোন ফল আসেনি।

কলম্বিয়াতে মাদক দমনে ২৬ বছর ধরে অভিযান চলছে। সেখানে এই অভিযানে এ পর্যন্ত ৯.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওখানে কোকেনের চাষ তো কমেইনি আরো বেড়েছে। দেশের বিরাট ভূখ- প্রায় ৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি এখনো কোকেন সম্রাটরা দখল করে রেখেছে। আফগানিস্তানে আমেরিকার ড্রোন উপেক্ষা করে পপি (কোকেনের) চাষ বেড়েছে। ২০০৮ সালে যেখানে ছিল মাত্র ২০০ টন, বর্তমানে বার্ষিক উৎপাদন প্রায় দশ হাজার টন। সুতরাং শুধু সাপ্লাই সাইড নিয়ে কাজ করলে মাদক নির্মূল করা যাবে না। আমাদের এর ডিমান্ড সাইড নিয়ে কাজ করতে হবে। ডিমান্ড টা কোথায় এটা খুঁজে দেখতে হবে। আসলে মানুষ নেশা করবেই। মানুষ হাজার বছর ধরেই নেশা করে আসছে। আমাদের দাদা-দাদী নানা নানীরা তামাক, হুক্কা এসব খেতে,পানে জর্দা খেতেন। এসবও নেশা। গাজা, চরস, ভাঙ এসব নেশার ইতিহাসও হাজার বছরের।

নেশা যারা করে তারা কেন করে? নেশা করার অন্যতম কারণ কাজ না থাকা। আমরা নেশা করিনা কেন? কারণ আমাদের অনেক কাজ থাকে।প্রতিদিন আমরা নানা রকম কাজে ব্যস্ত থাকি। মাদক নির্মূল করতে হলে তাই বেকার যুবকদের কর্ম সংস্থান নিশ্চিত করার দিকে জোর দিতে হবে। শিক্ষা ও সামাজিক সুষ্ঠু সংস্কার যদি না করা যায় তাহলে মাদক নির্মূল করা অসম্ভব। কারন আমাদের বিনোদনের ব্যবস্থা অবশিষ্ট নাই, মাঠ নাই, লাইব্রেরি নাই। মানুষ করবে কি? ছাত্রদের ভাল নেশা ধরিয়ে দিতে হবে। বই পড়ার নেশা, খেলাধুলার নেশা। এসব ভাল নেশা যদি কোনটা ঢুকিয়ে না দেওয়া হয় তাহলে তারা মাদকের নেশা তো করবেই।

আর পুলিশি ব্যবস্থা যেটা আছে এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে মাদক নিধনে পৃথিবী ব্যাপী লক্ষ লোক মারা গেছে এরকম ইতিহাসও আছে। মাদক বিরোধী অভিযানে ১৯৯০ থেকে ২০০৬ সালে সাড়ে চার লক্ষ লোক মারা গেছে কেবল কলম্বিয়ায়। ২০০৩ সালে থাইল্যান্ডে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রথম তিন মাসেই ২৮০০ লোক মারা গেছে। মেক্সিকোতে ২০১২ সালে মারা গেছে ১২ হাজার। পরের বছর সেই সংখ্যা দাঁড়ালো এক লক্ষ বিশ হাজার। তারপর শুরু হল নিখোঁজ হওয়া। তবে মাদক কিন্তু থেমে নেই। তাই ভয়াবহ এই অবস্থা দমন করার জন্য এরকম অভিযান দেশে দেশে পরিচালিত হয়েছে আমাদের দেশেও হচ্ছে। এই অভিযান পরিচালনার সময় মনে রাখতে হবেএর দ্বারা শতভাগ মাদক নির্মূল যেহেতু সম্ভব হবে না দুই চারজন মাদক ব্যবসায়ী অভিযানে ধরা না পড়লেও ক্ষতি নেই তবে একজন নিরপরাধ লোকও যেন এ অভিযান দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়,নিরপরাধ কারো যেন প্রাণ না যায় সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

মাদকের বিরুদ্ধে সাড়াশি এই অভিযানের পেছনেও কারন আছে। ছোটখাটো কেউ একবার মাদক ব্যবসা করে জেলে গেলেও সে জামিনে বেরিয়ে আসে। এবং তখন দেখা যায় তার বস হাতে একটা অস্ত্র তুলে দিয়ে তার পদোন্নতি দিয়েছে । তাই ভয়াবহ এই অবস্থা দমন করার জন্য এরকম অভিযান সাধারণত পরিচালনা করা হয়।

তাই সাময়িক এই অভিযান শেষে আমাদের মাদকের ডিমান্ড সাইডের উপর নজর দিতে হবে। মাদকের টার্গেট হিসেবে সাধারণত এতিম ছেলে মেয়েদেরকে ঠিক করে সাপ্লাইয়াররা। এতিম আবার দুই প্রকার। এক শ্রেনীর এতিম হল আসলেই যাদের বাবা মা নেই। আরেক শ্রেনী হল বাবা মায়ের স্নেহ ভালবাসা বঞ্চিত এতিম। যাদের বাবা মা থেকেও নেই। এরা একটা সময় একাকী ও হতাশ হয়ে পড়ে। তখন এদের অবলম্বন হয়ে যায় মাদক। তাই আমরা পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গুলোতে যদি জোর না দেই তাহলে শুধুমাত্র মাদকের সাপ্লাই চেইন বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে মাদকের সর্বগ্রাসী আক্রমণ থেকে আর আমরা রক্ষা পাব না।

প্রতিদিন দুই আড়াই হাজার জেলে নৌকা নাফ নদীর ওদিকে মাছ ধরতে যায়। ওদিক থেকে লঞ্চ স্টীমার এদিকে আসে। কোথায় কি দিয়ে দিচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করার সক্ষমতা আমাদের নেই। তাই আমি জোর দিয়ে বলছি শুধু মাত্র পুলিশি অভিযান পরিচালনা করে কেবল কিছুটা সাময়িক ফল পাওয়া গেলেও মাদক পুরোপুরি নির্মূল করা যাবেনা। পৃথিবীর কোথাও এটা নির্মূল হয়নি। এটাকে নির্মূল করতে হলে অবশ্যই মাদকের ডিমান্ড সাইড নিয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে।

নেশাজাতীয় দ্রব্যের চাহিদাকে বলা হয় ‘বাজে চাহিদা’( আনহোলসাম চাহিদা)। যে চাহিদা কোন বিজ্ঞাপন প্রচারণা ছাড়াই বাড়ে। কোনদিন কোন মাদক দ্রব্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি।আমাদের দেশে এত বিজ্ঞাপন দিয়েও সফট ড্রিংকসের বাজার বিশ্ব বিবেচনায় অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের। ইয়াবাকে বলা হয় ‘ক্রেজি ড্রাগস’। ফেনসিডিল যারা খায় এমন একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে পেনসিডিল কেন খায়? উত্তরে বলেছিল ‘উপকার হয় তাই খাই’। কি উপকার হয় জিজ্ঞেস করলে জবাব ছিল ‘ঝিম মাইরা থাকার জন্য খাই।’

অতএব যারা ফেনসিডিল খায় তারা ‘ ঝিম মাইরা থাকার জন্য খায়।’ অতএব ঝিম মাইরা থাকা হচ্ছে ‘ নীড ‘। সেই বিবেচনায় ফেনসিডিল একটা পণ্য কারণ এটা যে খায় তার ভাষায় এটার উপকার করার ক্ষমতা আছে। তাই নিশ্চিত করে বলা যায় ফেনসিডিল একটা পণ্য, আর বাজারে ঐ পণ্যই আসবে যার চাহিদা আছে। যদিও বাজে চাহিদা। ব্যবসায়ীদের এ নিয়ে ব্যবসা না করার পরামর্শ দিয়ে বেশি ফল পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ী ঐ পন্যই উৎপাদন ও বিতরণ করবে বাজারে যার চাহিদা আছে। এক্ষেত্রে বাজে চাহিদা যেমন- অধিক সংখ্যক সন্তানের আকাঙ্ক্ষা কমানোর ক্ষেত্রে সামাজিক বাজারজাতকরণ বা সোশ্যাল মার্কেটিং যেমনটি ব্যবহার করা হচ্ছে, ইয়াবার চাহিদার মত( যারা খায় তারা বলে ছটপট থাকার জন্য খাই) বাজে জিনিসের চাহিদা কমানোর জন্য সামাজিক বাজারজাতকরণ মতবাদ ব্যবহার করতে হবে। চাহিদার মূলে যেতে হবে। নেশার শ্বাশত ‘ নীড’ কে উন্নত পরিবেশ দিয়ে পরিশালিত করতে হবে। যেমন খেলাধুলা, শরীরচর্চা, বই পড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ইত্যাদি। যুব সমাজকে ‘ইনভলভড ‘ রাখা গেলে বাজে চাহিদা তাকে গ্রাস করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের চেয়ে মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রদের মধ্যে মাদক আশক্তি কম, ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকের নেশা নেই বললেই চলে। এর জবাবে কার্ল মার্কস হয়ত বলতেন ‘ধর্ম নিজেই একটি নেশা।’ মার্কসীয় সাহিত্যে ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মার্কসের উক্তি গ্রহণ না করেও বলা যায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও ধর্মাচারের নেশা যার মধ্যে ভালভাবে ঢুকেছে তার পক্ষে অন্য নেশা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।ধর্মভীরু লোক পরকালে শাস্তির ভয়ে অথবা পরকালে সমজাতীয় পন্যের পর্যাপ্ত সরবরাহের লোভে ইহকালে মাদক থেকে বিরত থাকে। অতএব বলা যায় নেশা নেশাকে ঠেকাচ্ছে। অতএব বাজারে আরো অনেকগুলো ভাল বিকল্প নেশা ছেড়ে দিলে, ভাল নেশা বাজে নেশাকে ঠেকাবে। ধর্মাচারের নেশাকে উদাহরণ হিসেবেই এক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে। অতিধর্মভীরু লোক যদিহ অশিক্ষিত হয় তাহলে সে ধর্মান্ধ হতে বাধ্য। ধর্মান্ধ হলেই জংগিবাদে উদ্বুদ্ধ হবে, সেটা আরেক নেশা, সেটাও বন্ধুক দিয়ে নির্মূল করা যায় না কেবল আপাতত দমন করা যায়।

লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়