নিজস্ব প্রতিবেদক: মাদক বিরোধী অভিযানের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক মো. কামাল হোসেন তার ফেসবুক একাউন্ট journalist Md Kamal Hossain-এ ‘নাটোর নামের এক মাদক সম্রাজ্যের কাহিনি’ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটির লেখা হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘নাটোর নামের এক মাদক সম্রাজ্যের কাহিনি’
বাংলাদেশের মধ্যে নাটোর একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। মাদক দ্রব্য এই জেলাতে কুটির শিল্পের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জেলাটি সম্প্রতি মাদক সম্রাজ্যে হিসাবে খ্যাতি পেয়েছে। কক্সবাজার যদি ইয়াবার রাজধানী হয়, তাহলে নাটোর হলো মাদকের রাজধানী। দেশের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় এই স্বীকৃতি পেতে সহায়ক হয়েছে।
অন্য জেলায় শুধু একটি মাদক ব্যবসা হয়, আবার তারা সেই মাদক সেবন না, শুধু ব্যবসা করে। কিন্তু নাটোরে একাধারে ইয়াবা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, গাজা, চোলাই মদ সহজ লভ্য, শুধু তাই নয় আর্চাষ্য হলেও সত্য নাটোরে যতগুলো মুদি দোকান আছে তার চাইতে বেশি আছে মাদক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মাদক মাফিয়াদের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে।
মাফিয়া প্রভাবে সম্ভবত সবচেয়ে করুণ অবস্থায় জিম্মি হয়ে আছে রাজনীতিবিদ, তারপর প্রশাসন, এরপর সচেতন সমাজ। আপাদত মনে হচ্ছে, যত ক্ষমতাবান হোক মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে নাটোরে থাকতে পারবে এমন ব্যক্তি নাই বললে চলে। সরকার যায় সরকার আসে, মাদক মাফিয়ারা বহাল তবিয়তে থাকে। সিনেমার গল্পের মতো অবিশ্বাস্য এক ভয়াবহ মাদক সম্রাজ্য নাটোর। এমনকি মাদক ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রণ নাটোর জেলার বাহির থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে বলে প্রভাবশালীদের ভাষ্য।
দেশে যদি মাদকদ্রব্য বৈধ করে দেয়া হতো তাহলে, নাটোর হতো দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র, কারণ নাটোরে শুধু ব্যবসায়ী নয়, রয়েছে বিশাল ভোক্তা শ্রেণি। এমন কোনো এলাকা নাই যেখানে মাদক বিক্রি হয় না। নাটোরে হয় তো এমন কোনো লোকও পাওয়া যাবে না, যে তার গোষ্ঠীদের মধ্যে কেউ মাদকসেবী নাই। তাই মান-সম্মান ও নিরাপত্তার কারণে প্রতিবাদ করার সাহস প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে নাটোরবাসীর।
এই জেলায় মাদকের সাথে রয়েছে জুয়া, চাঁদাবাজি সহ নানারকম অপরাধ প্রবনতা, এখন মহল্লার পর মহল্লা নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক ব্যবসায়ীরা, পুরনো মাদবররা এখন অসহায় হয়ে পড়েছে, বেড়েছে অপরাধ, আবার বিচারের নামে চলছে প্রহসন, হত্যা ধর্ষণসহ যে কোনো অন্যায় করলে উক্ত মাদক ব্যবসায়ী-মাদবররা তা থানা-পুলিশ করতে দেয় না। আবার দুই পক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে রায় দেওয়া গ্রাম্য বিচারে সংস্কৃতি হয়ে দাড়িয়েছে নাটোরে। নাটোরের গ্রামগুলো যেন এখনো মধ্যযুগের শাসন আমল পাড়ি দিচ্ছে।
এককালের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র নাটোর শহর থেকে এক-এক করে চাউলের ব্যবসা, ফলের ব্যবসা, কাঁচা মালের ব্যবসা, গুড়ের ব্যবসা, চামড়ার ব্যবসা ইত্যাদি চলে গেছে অন্যত্র, শুধু মাত্র মাদক কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি সহ নিরাপত্তার কারণে। উত্তরবঙ্গের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্রের খ্যাতির ঐতিহ্য হারিয়েছে নাটোর সর্বনাশা মাদক সন্ত্রাসের প্লাবনে।
এখনো নাটোর শহরের প্রাণ কেন্দ্র নিচাবাজার এলাকায় গ্রাম এলাকার বা অন্য জেলার ব্যবসায়ীরা অপহরণ আতংকে যেতে চান না। প্রায় শুনতে পাওয়া যায় জিম্মি করে টাকা আদায় করা হচ্ছে। সবই করা হয় প্রভাবশালী মাদক বাহিনীর প্রভাবে।
আবার শহরের চারপাশে শহরতলীতে তো মাদক জুয়ার বিশাল শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে। অনেকে আলিশান বাড়ি-গাড়ি এই মাদকের ব্যবসা থেকে করেছে। আর এই সকল ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয় শহর কেন্দ্রিক মাদক মাফিয়া দ্বারা। শহরতলীর মানুষগুলো মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে অসহায়ভাবে জিম্মি হয়ে আছে যুগের পর যুগ।
সেই সাথে নেশার টাকার জন্য ছেলে খুন করছে বাবা-মাকে, আবার স্বামী স্ত্রীকে, বাবা ছেলেকে, ভাই ভাইকে, ভাড়াটিয়া খুনী যাকে তাকে এমন ঘটনা ভুরি ভুরি রয়েছে অামাদের প্রাণের নাটোরে।
কিন্তু চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে কিছু লোককে ধরা হয়েছে বটে, তাদের বেশির ভাগ মাদক সেবনকারী, এতো রাখ-ডাক না করে, খোলাখুলি বলে ফেলি, চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। তাই বলে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড সমর্থন কিন্তু করছি না। চাই মাদকের ছোবল থেকে মুক্তি। মাদক-জুয়া মুক্ত নাটোর। আমাদের ঐতিহ্যের নাটোর। নিরাপদ নাটোর।
মাদক ব্যবসা উচ্ছেদে যদি প্রভাবশালী কারো কষ্ট হয়, তাহলে যেন মাদককে বৈধতা দেওয়া হয় আর মাদক ব্যবসাকে কুটির শিল্প হিসাবে ঘোষণা করা হয়। আমি দেখেছি আমার সম্ভাবনাময় অনেক বন্ধু-পরিচিত জনকে মাদকের ছোবলে হারিয়ে যেতে, তাদের অনেকেই আমার স্কুল জীবনের বন্ধু ছিল, তাদের করুণ পরিনতি বেদনাদায়ক, তারা হতে পারতো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বড় কিছু, করতে পারতো এই জনপদকে সমৃদ্ধ। তাদের চেহারাগুলো এখনো আমার চোখে ভাসে…
আপনার মতামত লিখুন :