জাকির তালুকদার: ‘বন্দুকযুদ্ধ’ যে আসলে কী জিনিস তা দেশের সব মানুষই এখন বোঝে। আর মানুষ যে বোঝে, এটি সরকার এবং র্যাব-পুলিশও জানে। সেই কারণে পরিভাষাটির কোনো পরিবর্তন আনা হয় না। সেইসাথে একই শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সরকার এটাও বুঝিয়ে দেয় যে, এই প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। সরকারকে এই কাজ থেকে বিরত রাখার কোনো শক্তি অন্তত দেশের সাধারণ মানুষের নেই। তদুপরি সরকার মনে করে, মাদক-ব্যবসায়ীদের এইভাবে নির্মূল করার উদ্যোগে মানুষের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়বে।
কাজেই এই ‘বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু’ খুব সহসা বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। তবু আমরা চাই, বিচার-বহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ড যেন না ঘটে। সেইসাথে কিছু কথা যোগ করতে চাই। এই প্রক্রিয়ার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। র্যাব-পুলিশের এই মাদকবিরোধী কার্যক্রমে কিছু নিরপরাধ মানুষও ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের শিকারে পরিণত হচ্ছে। কখনো কখনো ব্যক্তিগত রেষারেষির জের থেকে কোনো কোনো লোককে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। র্যাব-পুলিশের সোর্সদের কাউকে কাউকে এইরকম ভ‚মিকা নিতে দেখা যাচ্ছে। সোর্সদের অনেকেই সোর্স ‘পদের’ সুযোগ নিয়ে চাঁদাবাজি করে, মানুষকে ভয়-ভীতি দেখায়। এই ক্ষেত্রেও ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাই কেবলমাত্র সোর্সদের কথায়, নিজেরা খোঁজখবর না নিয়ে কোনো মানুষকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র শিকারে পরিণত করলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে মানুষের দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সমাজ গ্রহণ করে না। একটা পরিবারে সাধারণত একজন মানুষই উপার্জনকারী। কোনো পরিবারের সেই উপার্জনকারী ব্যক্তিগত এই ধরনের ভুলের শিকার হলে পরিবারটি নিশ্চিতভাবেই ধ্বংস হয়ে যায়।
এমপি বদির ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে খোলাখুলিভাবেই কথা হচ্ছে। আমরা অন্য এমপিদের ব্যাপারে একটা কথা বলতে চাই। অন্য এমপিরা ইয়াবা ব্যবসাতে যুক্ত এমন কথা বলছি না। তবে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা মাদক-ব্যবসার কথা সব এমপিই জানেন। তারা অবশ্যই জানেন যে কারা কারা তাদের এলাকায় এই ধরনের ব্যবসার সাথে যুক্ত। কিন্তু কোনোদিন আমরা কোনো এমপিকে দেখিনি একজন মাদক ব্যবসায়ীকে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে। তার অর্থ হচ্ছে, এমপি সাহেব জেনেও এই কাজটি চালিয়ে যেতে দিয়েছেন। আর কে না জানে যে এ ধরনের ব্যবসা কোনো গডফাদারের সহযোগিতা বা সমর্থন ছাড়া চালানো যায় না। এই দেশে এখন সরকারি দলের সমর্থন ছাড়া কেউ গডফাদার হতে পারে না। তো এতবছর পরে যখন মাদকবিরোধী অভিযান চলছে, তখন কোনো কোনো এমপিকেও কিছুটা সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যে ব্যাপারটি মনে রাখা দরকার, তা হচ্ছে এমপি সাহেবরা সত্যিকারের মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তথ্য দিচ্ছেন নাকি নিজদলের মধ্যকার প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন? যদি এই মাদকবিরোধী কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, তাহলে এইসব ‘ভুলের’ ঘটনাও বাড়তে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :