ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন, অস্ট্রেলিয়া থেকে: বছর দশেক আগের কথা, ছুটিতে দেশে গিয়েছি। এক অপরাহ্নে ঢাকায় বন্ধুপত্নীর আকস্মিক ফোন, কান্নাভেজা কণ্ঠ। প্রতিদিন বিকেল চারটেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে তার মেয়ে বেরিয়ে যায়, রাত করে ফেরে। জিজ্ঞেস করলে একেক সময় একেক কথা বলে। লেখাপড়ায়ও বেশ অমনোযোগী, ইতিমধ্যে এক সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছে। মায়ের ধারণা মেয়ে তার ইয়াবা আসক্ত। আমার বন্ধু পেশাগত কাজ নিয়ে ব্যস্ত, মেয়ের ব্যাপারটি নিয়ে তার তেমন কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হলো না। বন্ধুপত্নী অনেকটা অসহায়ের মতো আমাকেই অনুরোধ করে বসল। ‘পারলে আমার মেয়েটার জন্য কিছু একটা করেন।’ আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আমার কি আদৌ কিছু করার আছে? তবু তার কাছ থেকে মেয়েটির ফোন নম্বর নিয়ে বললাম, ‘দেখি কী করা যায়।’
মানসিক পরামর্শ নিয়ে আমার আগ্রহ অনেকদিনের। শিক্ষকতা পেশায় আসার পরে এ নিয়ে টুকটাক পড়াশোনা এবং প্রশিক্ষণও নিয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্যায় আমার এই অভিজ্ঞতাটুকু ভালোই কাজে দিয়েছে। বন্ধুপত্নীর অশ্রুভেজা কণ্ঠ শুনে মনে হলো, দেখিই না একটু চেষ্টা করে। অতঃপর তার সঙ্গে বিভিন্ন ক্যাফেতে অনেকটা প্রাণখোলা আড্ডার ছলে তিনদিন কথা বললাম। পাছে আবার যেন সে কাউন্সেলিংয়ের ব্যাপারটা বুঝতে না পারে সেটাও খেয়াল রাখতে হয়েছে। সেদিনের সেই বিপুল সম্ভাবনাময় বন্ধুকন্যাটি এখন চমৎকার একটি জীবনযাপন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং দেশব্যাপী পরিচিত এক মুখ। দূর থেকে তার সাফল্য দেখে আমার ভালোই লাগে।
অনুরাধার (ছদ্মনাম) সঙ্গে আমার রাজনৈতিক সুত্রে পরিচয়। তার বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়ার এক শহরে পড়তে এসেছে। আসার আগে অনুরাধা বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল, যেন আমি নিয়মিত ছেলেটার খোঁজখবর রাখি। আমি সেই শহরের এক পরিচিত অনুজসম চিকিৎসককে অনুরোধ করি। একদিন মধ্যরাতে ফোন আসে, ছেলেটিকে অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেছে। খবর পেয়ে ঢাকা থেকে ফোন, ওপ্রান্তে অনুরাধা কাঁদছে। বিস্তারিত জেনে আমি অবাক হই! ঢাকা থেকেই ছেলেটা মাদকাসক্ত, অস্ট্রেলিয়া এসে আরও বেড়েছে। প্রতিমাসে তাকে আমার মাসিক বেতনের সমান অর্থ পাঠানো হয়। পরিণতিতে একদিন আসক্তিজনিত অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতাল-পুলিশ। ছেলেটা আমার আত্মীয়। অনলাইন বিজনেস করে অল্প বয়সেই বেশ ধনী, অধীনস্থ তিন-চারজন সহকর্মীও আছে। কাজের ফাকে সবাই মিলে অফিসেই নেশা করে, এখন ঢাকার একটা পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। শুনে একটু মন খারাপ হয়। এমন প্রতিশ্রুতিশীল একটা তরুণ আজ মাদকের খপ্পড়ে পড়ে কী ভীষণ অসহায়!
আশির দশকের শেষ দিকে বন্ধুরা মিলে ‘লাইফ’ নামের একটা মাদকবিরোধী সংগঠন করেছিলাম। সেই থেকে আজ অব্দি মাদকবিরোধী নানান কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। তখনো বাংলাদেশে মাদক সমস্যা ছিল। তবে গত তিন দশক ধরে এই সমস্যাটা ক্রমেই বেড়েই চলেছে। আশির দশকের মাঝামাঝি হেরোইনের নেশার খপ্পড়ে পড়ে মেধাবী তারুণ্যের একটা বড় অংশ বিপথে চলে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ভারত থেকে আমদানীকৃত ফেন্সিডিলের নেশায় তারুণ্যের একটা উল্লেযোগ্য অংশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে সেসব ছাড়িয়ে ইয়াবার ছোবলে সারা দেশের তরুণ প্রজন্ম এখন হুমকির মুখে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও আজ ইয়াবার থাবা বিস্তৃত। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে তৈরি ইয়াবা চোরাইপথে টেকনাফ সীমান্ত হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরসমূহের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইয়াবা সেবনের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ইয়াবার ছোবল থেকে আজ আর ধনী-দরিদ্র, রাজনীতিবিদ বা প্রভাবশালী, কারও সন্তানই নিরাপদ না। অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা বোঝা যায় বর্তমানে মাদকের বিরূদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে। সাম্প্রতিককালে জঙ্গি-সন্ত্রাস মোকাবেলায় সরকারের যে কঠোর অবস্থান দেখা গেছে, মাদকের বিরূদ্ধেও সেরকম কঠোরতাই দৃশ্যমান। প্রতিরাতেই দেশব্যাপী ক্রসফায়ারে একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে, যাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই মাদক ব্যবসায়ে জড়িয়ে থাকার অভিযোগ। পুলিশ ও র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কণ্ঠেও মাদকের বিরূদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো একটা আয়োজন।
তারপরও কথা থেকে যায়। প্রথমত, শুরুতে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য আপাত সমর্থনযোগ্য হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্রসফায়ার কোনো সমাধান নয়। মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে যার ফলে সমাজে মাদকদ্রব্যের চাহিদা বিপুল হারে হ্রাস পায়। দ্বিতীয়ত, ক্রসফায়ারে মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরা নিহত হলেও মাদক ব্যবসার নেপথ্য গডফাদারদের কী হবে? তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে মাদক সমস্যা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে? সারা দেশে মাদক ব্যবসা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। কোথায় কোন স্পটে, কার কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় এটা গোপন কোনো বিষয় নয়। স্থানীয় ও জাতীয় মাদক ব্যবসায়ীদের একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয় আছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, রাজনীতিবিদসহ অনেক প্রভাবশালীরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। শহর এলাকার এইসব গডফাদারদের নাম মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে অনায়াসে উপার্জিত কোটি কোটি টাকার সুযোগ কি এইসব গডফাদাররা সহজে হাতছাড়া করতে চাইবে? দেশব্যাপী মাদক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে ইচ্ছুক সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় নিশ্চয়ই বিষয়টা আছে। এ ব্যাপারে তাই আগাম কোনো মন্তব্য না করে আমরা বরং একটু অপেক্ষাই করি, দেখি কোথাকার জল কোথায় গড়ায়!
আমাদের শুধু এটুকু মনে রাখতে হব, দেশ-জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে মাদকের বিরূদ্ধে যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে, এর কোন বিকল্প নেই।
লেখক : কবি ও চিকিৎসক।
আপনার মতামত লিখুন :