শিরোনাম
◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও

প্রকাশিত : ২২ মে, ২০১৮, ১০:৪৯ দুপুর
আপডেট : ২২ মে, ২০১৮, ১০:৪৯ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

নকল-ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি

সাঈদুর রহমান রিমন : রমজান মাস ও ঈদকে টার্গেট করে রাজধানীজুড়ে নকল কারখানা ও ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি শুরু হয়েছে। কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই যত্রতত্র কারখানা বসিয়ে ভেজাল খাদ্য ও নকল প্রসাধনীসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দেদার উৎপাদন চলছে। সেসব মানহীন, স্বাস্থ্যহানিকর খাদ্যপণ্যের বাজারজাতও চলছে প্রকাশ্যে, ঢাকঢোল পিটিয়ে। ইফতারির খাদ্যপণ্যও ভেজালের বিষমুক্ত থাকছে না। নকল কারখানায় উৎপাদিত প্রসাধনসামগ্রীগুলোও আকর্ষণীয় মোড়কে প্যাকেটজাত করে রাজধানীসহ সারা দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। সেসব বাজারজাতও হচ্ছে বাধাহীনভাবে। প্রতিবছর রমজান শুরুর অন্তত দুই সপ্তাহ আগে থেকেই বিএসটিআই, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো ভেজালবিরোধী নানা উদ্যোগ-আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ নানা রকম অভিযান চালানোর নির্দেশনাও দেওয়া হয় সর্বত্র। কিন্তু এবার অজ্ঞাত কারণে সংস্থাগুলো নীরব-নির্বিকার। সংশ্লিষ্টদের ঢিলেঢালা ব্যবস্থাপনার সুযোগেই নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারীরা ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠেছে। শুধু রমজানকে পুঁজি করে রাজধানীতেই রাতারাতি গড়ে উঠেছে ১০ সহস্রাধিক ভুঁইফোড় কারখানা। বিভিন্ন বস্তি এলাকা ছাড়াও বাসাবাড়ির আবাসিক ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েও নকলবাজরা নানা রকম কারখানা স্থাপন করেছেন।

অসংখ্য কারখানায় তৈরি হচ্ছে নকল, মানহীন-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাংলা সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, নুডলস, ঘি, হলুদ, মরিচ, মসলা, বেসন, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, পাউরুটি, কেক ইত্যাদি। এসব ভেজাল পণ্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নানা উপকরণ ও রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামাল, ফরমালিন-কার্বাইড, সুতা রাঙানোর বিষাক্ত রং, ভেজাল পাম তেল, সেন্ট, পচা ডিম ইত্যাদি মেশানো হচ্ছে এসব খাদ্যপণ্যে। প্রতিবছরই রমজান মাস ঘিরে এই অসাধু ব্যবসায়ীরা আটঘাট বেঁধে নামেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে অনেকটা কৌশলে বাইরে তালা ঝুলিয়ে আলো-আঁধারি পরিবেশে উৎপাদন করা হয় সেমাই, নুডলস, ঘিসহ অন্যান্য পণ্য। শ্রমিকদের ঘাম অবাধে মিশে যাচ্ছে সেমাইর খামিরে। ছোট ছোট বাঁশের কঞ্চিতে কাঁচা সেমাই সাজিয়ে শুকানো হচ্ছে বদ্ধ ঘরে মাচা বানিয়ে। এসব সেমাই লাল করা হচ্ছে বিস্কুট তৈরির চুল্লিতে। পরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেবেল সেঁটে টুকরি ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোটা রীতিমতো অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। চাল, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, আলু থেকে শুরু করে রুটি, কেক, মিষ্টি, বিস্কুট কিছুই ভেজালের ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না। জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি ‘পানি’ পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না। যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর-ডোবা এবং ওয়াসার পানি সরাসরি গামছায় ছেঁকে বোতলজাত করা হচ্ছে। সে পানিতে থাকছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম-লেড-ইকোলাই। অথচ এগুলোই ‘বিশুদ্ধ মিনারেল পানি’ হিসেবে নামিদামি কোম্পানির সিলমোহরে সরবরাহ করা হচ্ছে। কলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস থেকে শুরু করে আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তরের জন্য অধিক ক্ষারজাতীয় টেক্সটাইল রং ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাছে থাকা পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রির মুহূর্ত পর্যন্ত একেকটি ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যাসজাতীয় ইথাইলিন ও হরমোনজাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে, ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণেই ফলগুলো বিষে পরিণত হয়। ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই ফলমূলে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো হয়। অন্যদিকে ফলমূল দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করতে ফরমালিনসহ আরও কিছু বিষাক্ত পদার্থেরও ব্যবহার চলে অহরহ। এভাবেই নানা কৃত্রিমতায় খাদ্যদ্রব্যাদি যেমন ভেজাল ও বিষে পরিণত করা হচ্ছে, তেমনি সেসব হয়ে পড়ছে স্বাদহীন-গন্ধহীনভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরমালিন উচ্চমাত্রার বিষাক্ত পদার্থ। এর কারণে দ্রুত কিডনি, ক্যান্সার, লিভার সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুদের হার্টের রোগ ও দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। গর্ভজাত মায়ের শিশুও বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।

মসলায় ভেজাল আরও বেশি : মসলায় ভেজাল আরও বেশি। অধিক মুনাফার জন্য একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মসলায় কাপড়ের বিষাক্ত রং, দুর্গন্ধযুক্ত পটকা মরিচের গুঁড়া (নিম্নমানের মরিচ), ধানের তুস, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মটর ডাল ও সুজি ইত্যাদি মেশাচ্ছেন। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, ভেজাল মসলা কিনে ক্রেতারা শুধু প্রতারিতই হচ্ছেন না, এতে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। কারণ ভেজাল মসলায় মেশানো ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভেজাল মসলা উৎপাদনকারীরা গুঁড়া মরিচের সঙ্গে মেশাচ্ছেন ইটের গুঁড়া। হলুদে দেওয়া হচ্ছে মটর ডাল, ধনিয়ায় স’মিলের কাঠের গুঁড়া আর পোস্তাদানায় সুজি। মসলার রং আকর্ষণীয় করতে মেশানো হচ্ছে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল। রাজধানীর শ্যামবাজার, কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজার, টঙ্গী ও মিরপুর এলাকার বিভিন্ন পাইকারি মসলার বাজার এবং ভাঙানোর কারখানায় এসব ভেজাল মেশানো হচ্ছে। তবে হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভেজাল মসলা মেশানোর হার বেশি। বেসনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে আটা। আটায় হলুদ রং ব্যবহার করায় তা বেসনের রং ধারণ করছে। এ ছাড়া রসনাবিলাসের চাহিদা মেটাতে আরও কিছু আইটেম থাকে। তাতে ভেজালও থাকে সমপরিমাণ। বিভিন্ন নাম না জানা কেমিক্যাল আর পেঁয়াজের রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় ১ নম্বর খাঁটি সরিষার তেল। দুধে আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, এরারুট মেশানো হয়। দুধের মধ্যে রাসায়নিক কেমিক্যাল, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, বোরিক অ্যাসিড, স্যালিসাইলিক, ইউরিয়া, চিনি, লবণ, সোডিয়াম বেনজোয়েট, সোডিয়াম কার্বনেট, ফেভার, ক্ষতিকর রং, আলকাতরার রং, আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, শ্বেতসার ও স্কিম মিল্ক পাউডার মিশ্রণ করে বাজারজাত করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলা বলেন, মসলায় ব্যবহৃত কাপড়ের রং শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর কারণে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে মানবদেহে হেপাটাইটিস এবং কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এবারও এসব এলাকায় অসংখ্য কারখানায় তৈরি হচ্ছে নকল, মানহীন-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাংলা সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, নুডলস, ঘি, হলুদ, মরিচ, মসলা, বেসন, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, পাউরুটি, কেক ইত্যাদি। এসব ভেজাল পণ্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নানা উপকরণ ও রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামাল, কার্বাইড, সুতা রাঙানোর বিষাক্ত রং, ভেজাল পাম তেল, সেন্ট, পচা ডিম ইত্যাদি মেশানো হচ্ছে এসব খাদ্যপণ্যে।

নকল কারখানার সন্ধানে : বিএসটিআইর তথ্যে জানা যায়, দেশে সরকারি অনুমোদন রয়েছে এমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রসাধনী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। এযাবৎ ৯৭টি প্রতিষ্ঠানকে সিএম লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শুধু রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতেই গড়ে উঠেছে আট শতাধিক প্রসাধনী কারখানা। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, বড় কাটরা, সদরঘাট, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, রহমতগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, ইসলামবাগ, বংশাল, শ্যামপুর, কদমতলী, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর, পোস্তগোলা, ধোলাইখাল, ফরিদাবাদ, ইসলামপুর, সোয়ারীঘাট, দেবীদাস লেন, কামালবাগ, শহীদনগরে নকল কারখানার ছড়াছড়ি রয়েছে। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরার লছমানগঞ্জ, বুড়িশুর, মান্দাইল, কালিন্দিতে আছে শতাধিক নকল কসমেটিকস কারখানা। টঙ্গীসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের পাগলার বেশ কয়েকটি জায়গায় নকল প্রসাধন তৈরির গুদাম ও কারখানা রয়েছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা প্রসাধন প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই নকল বাণিজ্য চালাচ্ছে। বাজারে প্রচলিত প্রসাধনীর বোতল বা কৌটা, লেবেল ও ট্রেডমার্ক নকল করে হুবহু নকল তৈরি করছে এসব চক্র। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকার গোডাউনগুলো থেকে প্রতিদিন ভোরে নকল স্টিকার ও লেবেল লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি ও প্রসাধনসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে পাইকারি দোকানগুলোতে। চকবাজারের চক সার্কুলার রোডের চক সুপার মার্কেট, চকমোগলটুলী, মনসুর প্লাজা, মকিম কাটারার ফালু সুপার মার্কেট, মমতাজ মার্কেট, রুই হাট্টা লেন, খান মার্কেট, ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট, মৌলভীবাজার, জোহা মার্কেট, শামীম মার্কেট, ফেন্সি মার্কেট ও বড় কাটরা এলাকায় দুই শতাধিক ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আছে। এই পাইকারদের কাছে দেশি-বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি অখ্যাত ব্রান্ডের ক্রিম, স্নো, পাউডার, কাজল, নেইলপলিশ, লিপস্টিক, লোশন, চুলের ক্রিম, শেভিং ক্রিম, শেভিং ফোম, শেভিং লোশন, শ্যাম্পু, সুগন্ধি ও বডি স্প্রে সবই রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়