দীপক চৌধুরী : ১৯৭১-এর ভয়ংকর চিত্র চোখের সামনে ননান সময়ই ভেসে ওঠে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকার এসব প্রসঙ্গ আলোচনায় এলেই। সেই '৭১-এ আমাদের প্রাণ বাঁচাতে সন্তানদের নিয়ে একজন মানুষ কীভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তা ভুলবার নয়। তিনি আমার গ্রামের রোয়াব উল্লাহ্। আমরা গোটা পরিবার তখন উঠেছি নৌকায়। তাঁর পুত্রদের সঙ্গে নিলেন।
জীবনবাজি রেখে নৌকার পেছনের গলুইয়ে হাল ধরে মাইলের পর মাইল চলেছিলেন সেদিন। উদ্দেশ্য আমাদের রক্ষা করা। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষটির কাছে মনে হয়েছে এটি তাঁর দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে শেষ পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হিসেবে বিশ্বাস করি-- মুক্তিযুদ্ধ শুধু আবেগের ব্যাপার নয়, আমাদের অস্তিত্বেরও। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এদেশের হাজার হাজার তরুণ ছুটেছিল মুক্তযুদ্ধে। যেমন, যে ব্যক্তির ওপর একমাত্র নির্ভরশীল একটি পরিবার সেই ব্যক্তিও ছুটে গেছে যুদ্ধে। যে সন্তান নিজেও জানে তাঁর ওপরই সংসারটি নির্ভরশীল; সেই সন্তানও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। নবদম্পত্তির নবরাত্রির চেয়েও ছিল অধিকতর মূল্যবান এই যুদ্ধ। সেই যুদ্ধকেই কেন্দ্র করে আমার লেখা ( ১৯৮৬-তে সাপ্তাহিক রোববারে ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত) প্রায়োপন্যাস "দেশান্তর"পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রয়াত কবি রফিক আজাদ।
কিন্তু এখন একশ্রেণির মানুষের কর্মকান্ড দেখে ক্রমেই বিস্মিত হচ্ছি। ভাবিত করে যে, "আমি রাজাকার" শব্দ দুটি কিসের ইঙ্গিত বহন করে? আমি তো মনে করি, গোড়ায় যেতে হবে। কারণ, এটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। সবাই জানি, ২০১৮ সাল নানা কারণেই আলোচনায় জায়গা করে নেবে। এটা নির্বাচনের বছর, স্থানীয় আর জাতীয় নির্বাচন উভয়ই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনী আমেজে জাতীয় নির্বাচনের স্বাদ দেখছেন অনেকেই। কিন্তু বিএনপি দেখছে না। এরমধ্যেই দলটির নেতারা বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার অভাব ও একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে নালিশ করেছেন। লিখিত বক্তব্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ তুলে ধরে তারা মূল শত্রু গণ্য করেছেন আওয়ামী লীগকে। তাদের কী রকম দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদ ছিল বা আছে তাতো প্রমাণিতই। কারণ, ১৯৭১-এর রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের মন্ত্রী বানিয়েছিল দলটি।
রাষ্ট্রীয় পতাকা দিয়ে ও রাজাকারদের প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে বিএনপি চমৎকারভাবে আধিপত্য প্রদর্শনের সুযোগ দিয়েছিল। সেই রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের ফাঁসি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অথচ "আমি রাজাকার" দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে ভাবি-- এটাই কী আমাদের লাল-সবুজের বাংলাদেশ? কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাত্রা যখন তুঙ্গে তখনই দেখলাম এক ছাত্র নিজের বুকে "আমি রাজাকার" কথাটি লিখে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো জাতির সন্তানতো তা হতে পারে না! নেতা মোদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভুলে যাওয়া যাবে না। কোটা সংস্কার চাই কিন্তু এই দাবির নামে যে আন্দোলনটি তা কী কেবল চাকরিপ্রার্থীর আন্দোলন!
প্রজ্ঞাপন জারি করার দাবি জানিয়ে হুমকি দেওয়া কিসের ইঙ্গিত বহন করে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বাসাটি গুঁড়া গুঁড়া যারা করলো তারা কারা? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যেখানে চাকরির জন্য আন্দোলনে যাওয়ার কথা নয়-- তারাও সেখানে গেলো কীভাবে-- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা খুব জরুরি। চ্যালেঞ্জিং পেশায় সাহস নিয়ে এলেও নারীরা নানা বাধার মুখে পড়েন। কিন্তু মিছিলের ছাত্রীদের চোখ-মুখ দেখে মনে হলো, এখন নারীরা বাধা-কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। সত্যিই কী তাই? কেনো বলা হয়ে থাকে প্রান্তিক মানুষকে পেছনে রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়!
মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছাসাধনের বাসনা হরণ করা ঠিক নয়। তবে এর মাপকাঠি থাকতে হবে। শহর-নগর খেয়ে দেয়ে মোটা হবে, বিরাট অংকের বাজেট থাকবে আর বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃণমূলের মানুষ; এই অসাম্যের তীব্র বিরোধী আমি। কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে ভিসির বাসভবনে তান্ডব, "আমি রাজাকার" লিখে গর্ব করা, রাতারাতি সবকিছু ধুয়ে ফেলার কঠিন উদ্যোগের নেপথ্যচারীদের মুখোশ উন্মোচন জরুরি। সিদ্ধান্তে যেন সেই চেনা শামুকে পা না কাটে!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ঔপন্যাসিক/ সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
আপনার মতামত লিখুন :