ডেস্ক রিপোর্ট: বেপরোয়া পরিবহন চালনায় একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। এত রক্ত আর ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরও ঘুম ভাঙছে না চালকদের। কোন উদ্যোগেই থামানো যাচ্ছে না এই মৃত্যুর মিছিল। এখনো কমেনি বেপোরয়া গতি। কমেনি ওভারটেকিং।
বরং চালকদের মধ্যে বেড়েই চলেছে যাত্রী উঠিয়ে অধিক আয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। দ্রুত ট্রিপ ধরতে অরক্ষিতভাবে যাত্রীদের নামানো হচ্ছে সড়কের মাঝখানে। ফলে বেপরোয়া চালকদের দাপটে চার দিকে জমদূতরা প্রতিনিয়তই হাতছানি দিচ্ছে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর গুলিস্থান, পল্টন মোড়, প্রেসক্লাব, শাহাবাগ, বাংলামোটর, মগবাজার মোড়সহ আরো কয়েকটি ব্যস্ততম এলাকার সড়কে নজরে এসেছে এমন দৃশ্য। শাহাবাগ মোড়ে দেখা গেছে, চিরিয়াখানা থেকে সদরঘাটগামী তানজিল পরিবহনের একটি বাস মোড় না ঘুরতেই হালকা ব্রেক করে হেলপার বাম হাত তুলে রাস্তার মাঝখানেই নামিয়ে দেয় এক যাত্রীকে। ঠিক সে সময় একই দিক থেকে দ্রুতগতিতে ছুটে আসে চন্দ্রা টু মতিঝিলগামী ওয়লেকাম পরিবহন। রাস্তার মাঝে ওই যাত্রীকে দেখে শক্তভাবে ব্রেক করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে সড়ক পার হন ওই যাত্রী।
জাহিদুল নামের ওই যাত্রী বলেন, ভাই পল্টন থেকে উঠেছি। আমি হেল্পার আর চালককে অনুরোধ করেছি। বার বার বলেছি ভাই একটু সাইডে চাপান। ওরা কথাই শুনেনি। দরজায় এলে এক পর্যায়ে হেল্পার বলেন, ভাই তাড়াতাড়ি নামেন। লোক উঠবে। আরে...নামেন কিছুই হবে না। আমি হাত দিয়ে সিগনাল দিয়েছি। তিনি বলেন, ভাই আমি নামতেই চাইনি তারা এক পর্যায়ে আমাকে জোড় করে নামিয়ে দিয়েছে। অথচ ওঠার সময় পল্টনে সব যাত্রীরাই বারবার তাগদা দিচ্ছিল। ওই বাসটির জন্য রীতিমতো রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়েছিল। আর নামানোর সময় এই হাল। অল্পের জন্য রক্ষা পেলাম।
একটু এগিয়েই যানজটে আটকে থাকা তানজিল পরিবহনের চালককে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আরে ভাই কোনো সমস্যা নেই। কিছু হইছে কি? কোথাও লাগছে গাড়ি? তাহলে? আমি জানি কিছুই হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লুকিং গ্লাস ভাঙা তাতে সমস্যা কি? আমি জানি কোথায় নামাতে হয়। ওই মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ বলেন, আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি। এখানে গাড়ি বেশি সময় দাঁড়াতে দেই না। এরপরও যদি চালকরা এসব কাজ করে। এদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই শাস্তির ব্যবস্থা হচ্ছে। তারপরও সোজা হচ্ছে না।
শুধু শাহাবাগ-ই নয়, রাজধানীর প্রেসক্লাব এলাকায় সড়কে দেখা গেছে আরো ভয়াবহ দৃশ্য। ওই সড়ক দিয়ে আসা অধিকাংশ বাসই চলছে বেপরোয়া গতিতে। যাত্রী নামাচ্ছে সড়কের মাঝখানেই। থেকে থেকে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে যাত্রীরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর মিরপুর থেকে আসা বিটিসিএল পরিবহনের একটি বাস প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তার মাঝখানে নামিয়ে দেয় এক যাত্রীকে। একই সময় রাস্তার ওই বাসে বাম দিক থেকে দ্রুতগতিতে আসছিল কলাবাগান থেকে আরামবাগগামী এমটিসিএল পরিবহনের একটি বাস। রাস্তার মাঝে লোক দেখে হার্ড ব্রেক করেন চালক। ফলে অল্পের জন্য রক্ষা পায় ওই যাত্রী।
রাস্তার মাঝখানে যাত্রী নামানোর বিষয়ে ট্রাফিক বিশেষজ্ঞ এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মারুফ রহমান বলেন, রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থায় এমন অব্যবস্থাপনা একেবারেই অমার্জনীয়। এটা খুবই শোচনীয়। যেখানে সেখানে হাত দেখালেই গাড়ি থামবে, আবার নামতে চাইলেই নামিয়ে দেয়া হবে সড়কের মাঝখানে এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন ও ডিএমপি নির্ধাতির কিছু স্টপেজ আছে সেখানে গাড়ি দাঁড়াবে এবং যাত্রীরা উঠা-নামা করবে। কিন্তু এটা কেউ মানে না।
তিনি আরো বলেন, এরা মূলত মালিকদের কাছ থেকে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি লিজ নেয়। প্রতিদিন মালিককে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দিতে হয়। আর এপর বাকি যা থাকে সেটা তাদের লাভ। এজন্য রাস্তায় নামার পর এদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যত বেশি ট্রিপ মারতে পারবে তত বেশি টাকা। এই সংস্কৃতি বন্ধ হলে বেপরোয়া গতি কিছুটা হলেও কমবে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়কে এমন হাজারটা সমস্যা আছে। তবে সব থেকে জরুরী দায়িত্ব পালন করা। সবাই সবার দায়িত্ব পালন করলে এমনটা আর হত না। তিনি বলেন, দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে। শুধু তাই নয়, আইন প্রয়োগে আরো কঠোর হতে হবে। তাহলেই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সম্প্রতি ঘটনাগুলো সব পরিবহন মালিকদের নাড়া দিয়েছে। এভাবে আর চলবে না। গত কয়েক দিন ধরেই আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা করছি। আশা করছি খুব দ্রুত একটা ভালো সিদ্ধান্ত আসবে। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব স্বীকার করেন চালকদের মধ্যে কিছু অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে। অধিকাংশ চালকই অশিক্ষিত। শুধু তাই নয়, তাদের দক্ষতারও প্রচুর অভাব রয়েছে।
সূত্র: ভোরের কাগজ
আপনার মতামত লিখুন :