শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, সারাদেশে চলাচলকারী বাস-ট্রাকগুলো এখন সাক্ষাৎ যন্ত্রদানবে রূপ নিয়েছে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব ও নিয়মনীতির অজ্ঞতায় প্রতিনিয়ত ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় ঘটছে প্রাণহানি। বেঁচে গেলেও মেনে নিতে হচ্ছে পঙ্গুত্বের জীবন। তবে দুঃখজনক বিষয় দুর্ঘটনায় কেউ মরলেও দোষী চালকের শাস্তি দাবি করতে পারছে না। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়ীদের আটক করলেই চলে আন্দোলন।
যাত্রীকল্যাণ সমিতি তাদের সমীক্ষায় জানিয়েছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৭৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮৪১ জনের প্রাণহানি ও ৫৪৭৭ জন আহত হয়েছে। পঙ্গু হয়েছেন ২৮৮ জন। ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়াভাবে চলাচল করে।
এদিকে দুর্ঘটনার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই বলে মনে করছে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউট। তাদের মতে, দুর্ঘটনার মূল তথ্য সংগ্রহকারী পুলিশ অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যায়। বুয়েটের হিসাবে, বাংলাদেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৬৮ দশমিক ৪১ শতাংশের পেছনে বাস ও ট্রাক জড়িত। দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ১ শতাংশেরই উৎস বাস। ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ দুর্ঘটনায় যুক্ত ট্রাক। ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাবে। সম্প্রতি কারওয়ানবাজারের সোনারগাঁও মোড়ে এমন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে ডান হাত হারানোর পর প্রাণ গেছে কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের। পলাশী এলাকায় বাসচাপায় আহত পুলিশের পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেনের অবস্থা এখনো সংকটজনক। দুর্ঘটনার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার মেয়েকে স্কুলে দিতে যাওয়ার সময় নিউমার্কেট এলাকায় বিকাশ পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে আহত রিকশাযাত্রী আয়েশা খাতুন সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসাধীন। বনানীতে বিআরটিসির দোতলা বাসের চাপায় রোজিনা নামের এক তরুণী পা হারিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। গোপালগঞ্জে বাসের সঙ্গে ট্রাকের ঘষায় ডান হাত হারানো খালিদ হোসেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায়। তিনি বাসচালকের সহকারী ছিলেন। গত রবিবার বগুড়ার শেরপুরে বাসের ধাক্কায় ৮ বছর বয়সী শিশু সুমি খাতুনকে হাত হারাতে হয়েছে। একই দিন রংপুরের মাহিগঞ্জে ট্রাকের চাপায় ৪ বছরের শিশু মেঘলা মনির পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পরিবহন শ্রমিকের জীবনও দুর্ঘটনায় চলে যেতে পারে এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত গতকাল পল্টনের ঘটনা। গতকাল পল্টন মোড়ে সুপ্রভাত ও শতাব্দী পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে বাসচালক মিজান নিহত হন। আহত হন অন্তত ৮ জন।
প্রশিক্ষণ ছাড়াই চালকের আসনে : আইনানুযায়ী ২১ বছর বয়সী পেশাদার চালককে প্রথমে হালকা যান চালনোর জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর তিন বছর পর মাঝারি যান এবং এর তিনবছর পর মেলে ভারী যান চালানোর লাইসেন্স। কিন্তু চালকের আসনের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সামনেই অনভিজ্ঞ, অল্পবয়সী কিশোরের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং। ব্র্যাকের এক গবেষণা অনুসারে ভারী যানবাহনের ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ চালকই ‘ওস্তাদে’র (মূল চালকের) সহকারী থেকে চালক হয়েছেন। এরা গাড়ি চালানোর কোনো নিয়ম জানে না।
ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না হতাহতরা : সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ মিলছে না। গণমাধ্যমে আলোচনায় এলে রোজিনাকে বিআরটিসির পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা অথবা খালিদ নামের আহত চালকের সহকারীকে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার খবর ফলাও করে প্রচারের আশা করে সংশ্লিষ্টরা। আর শাস্তির উদাহরণ ঘাঁটলে তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মতো আলোচিত ঘটনা কম। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে আহতরা পঙ্গু হয়ে বিভীষিকাময় জীবন পার করছে তার খবর রাখে না কেউই। দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে গোটা পরিবারকে নিঃস্ব করে গেছেন এমনটি মনে রাখে ক’জন। আর শাস্তি; সে তো আশা করতেই বারণ করছে পরিবহন নেতারা। তাদের মতে, ইচ্ছা করে কেউ দুর্ঘটনা ঘটায় না তাই মারলেও শাস্তি মুখে আনা যাবে না।
দুর্ঘটনা এবং সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে আইন পাস হচ্ছে না পরিবহন নেতাদের আপত্তিতে। কারণ শাস্তি চান না তারা। যে কোনো অজুহাতে মানুষ জিম্মি করে ধর্মঘটের ডাক দেন। এ অবস্থার উত্তরণে এখন বাস কোম্পানি গঠনের চিন্তা করছে সরকার। এতে করে দুর্ঘটনা কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র : আমাদের সময়
আপনার মতামত লিখুন :