শিরোনাম
◈ সাভারে শো-রুমের স্টোররুমে বিস্ফোরণ, দগ্ধ ২ ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ চলচ্চিত্র ও টিভি খাতে ভারতের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলেই ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের

প্রকাশিত : ১৪ এপ্রিল, ২০১৮, ০৯:২৬ সকাল
আপডেট : ১৪ এপ্রিল, ২০১৮, ০৯:২৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাতিল নয়, সংস্কারেই সমাধান

আলী রীয়াজ : কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবসানের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক। কয়েক মাস ধরে যে তরুণেরা এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং গত কয়েক দিনে পুলিশের নির্যাতনের শিকার ও সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা তাঁদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলেছে। সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে যথাযথ বলে বর্ণনা করছেন।

রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে তাঁরাই আগ বাড়িয়ে প্রশংসা করছেন, যাঁরা এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেও যেকোনো ধরনের পরিবর্তনের দাবির মধ্যে ষড়যন্ত্রের জাল দেখতে পেয়েছিলেন এবং এ ধরনের সংস্কারকে রাষ্ট্রবিরোধী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবমাননাকর বলে বর্ণনা করেছেন। সামান্য পরিবর্তনকেও অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে, কিন্তু কোনো রকম কারণ ছাড়াই এখন পুরো কোটাব্যবস্থা বাতিলকে অভিনন্দন জানানোর মধ্যে যে স্ববিরোধিতা আছে, তা ওই সব ব্যক্তির না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এখন তাঁদের প্রতিক্রিয়ার মূল সুর হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের সব দায় আন্দোলনকারীদের। তাঁরা জানেন যে আন্দোলনকারীদের দাবি বাতিলের দাবি ছিল না। প্রধানমন্ত্রীও তা জানেন।

যাঁরা এখন সরকারি সিদ্ধান্ত সমর্থনে অকুণ্ঠিত, তাঁদের বক্তব্যে এটা তাঁরা স্বীকার করেই নিচ্ছেন যে এই সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক নয়; কিন্তু যেহেতু এর দায় অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, তাতে করে তাঁরা এখন এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তার কারণও সুস্পষ্ট-এটি ভালো রাজনৈতিক কৌশল এবং তাতে করে আন্দোলনকারীরা বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। ছাত্রলীগের ‘আনন্দ মিছিল’ এবং সরকার-সমর্থকদের এই প্রতিক্রিয়া একই সূত্রে বাঁধা-এর থেকে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া গেলে, এমনকি তা যদি সাময়িকও হয়, তাতে যদি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের ক্ষতির আশঙ্কাও থাকে, তাতেও তাঁরা বিব্রত নন। আন্দোলনকারী ও তাঁদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, অথচ এই সিদ্ধান্ত যে রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত, সেটা সরকার-সমর্থকেরা অস্বীকার করছেন না।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে বহুভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা হয়েছে। ২০১৩ সালে যখন প্রথম এ বিষয়ে ক্ষোভ আন্দোলনে রূপ নেয়, তখন থেকেই সেই চেষ্টা হয়েছে। ২০১৩ সালে এ ধরনের প্রচেষ্টা সফলও হয়েছে। এই দফায় একে কোটা বাতিলের আন্দোলন বলে অভিহিত করার চেষ্টা যখন সফল হয়নি, তখন প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত একে সেই জায়গায় নিয়েই দাঁড় করাল। শেষ পর্যন্ত সব ধরনের কোটা বাতিলের জন্য সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হোক অথবা না হোক, যে তরুণেরা এই আন্দোলনে যুক্ত, ভবিষ্যতে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের ব্যত্যয়ের জন্য তাঁদের দায়ী করার পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের কারণে নারীরা বঞ্চিত হবেন-এই ভবিষ্যদ্বাণী করে তার জন্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি কেউ কেউ ইতিমধ্যে শ্লেষাত্মক বাক্য ছুড়ে দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।

সংস্কারের দাবির বিরোধিতা করতে গিয়ে একে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা বলে সরকার-সমর্থকেরা বলে এসেছেন। আন্দোলনকারীরা সব সময় বলেছেন যে তাঁরা কখনোই মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নন। বিরাজমান ব্যবস্থায় সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য যে ৩০ শতাংশ কোটা রয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪৭ বছর পরে এই কোটার সুবিধা যে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা পাচ্ছেন না তা বোধগম্য; এর সুবিধা পাচ্ছেন তাঁদের উত্তরসূরিরা। মনে রাখা দরকার, ‘সরকারি কর্ম কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৮২ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা লক্ষণীয় মাত্রায় কমতে শুরু করে। ১৯৮৯-৯০ সাল নাগাদ এটি ১ শতাংশে নেমে আসে, বাকি ২৯ শতাংশ কোটা অপূর্ণ থেকে যায়।’ (‘রাজাকারের বাচ্চা’ বনাম মুক্তিযোদ্ধা কোটা’, শাখাওয়াত লিটন, ডেইলি স্টার, ১১ এপ্রিল ২০১৮)।

১৯৯৬ সালে কোটাব্যবস্থায় সংস্কার করে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে অপূর্ণ কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিধান চালু করা হয়’। যে ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রহণযোগ্য তালিকা তৈরি করা যায়নি, সেখানে তাঁদের উত্তরসূরি নির্ধারণের উপায় এবং তার সম্ভাব্য অপপ্রয়োগের বিষয়কে অস্বীকারের উপায় নেই।

কোটাব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর জন্য ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রয়েছে। যেকোনো ধরনের সংস্কার প্রতিটি ক্যাটাগরির ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হবে। কিন্তু এর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গকে এককভাবে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে সংস্কার প্রস্তাবকেই এমনভাবে চিত্রিত করা হলো এবং তা বাতিলের মধ্য দিয়ে সংস্কারের দাবিদার তরুণদের এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করানো হলো, যেন মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরি ও তরুণেরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ এই তরুণদের মধ্যেই যে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিরা আছেন, তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।

১৯৮৭ সাল থেকে এক দশক ধরে সরকারি কর্ম কমিশন সামগ্রিক কোটাব্যবস্থায় সংস্কারের কথা বলে এসেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব সরকারি কর্ম কমিশনের পক্ষ থেকেই প্রথম দেওয়া হয়েছিল। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, তাঁদের অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা’ করে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তাতে এমন ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হলো যেন আন্দোলনকারীরা কেবল একটি ক্যাটাগরির ব্যাপারেই সংস্কার দাবি করছিলেন।

একবার সংস্কার করলেই বারবার সংস্কারের দাবি উঠবে বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এমন ধারণা দেয় যে এই কোটাব্যবস্থা আগে কখনোই সংস্কার করা হয়নি। অথচ গত ৪৭ বছরে একাধিকবার সংস্কারের ঘটনা ঘটেছে, সেটা তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন-‘১৯৭২ সাল থেকে এই কোটা পদ্ধতি চলছে। সময়-সময় সংস্কার করা হয়েছে।’ সেটাই স্বাভাবিক। এখন রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে যেভাবে সংস্কারের দাবিকে মোকাবিলা করা হলো, তাতে করে ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও অসন্তোষের পথকেই উন্মুক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভক্ত দেশে আরও একধরনের বিভক্তির সুযোগ থেকে ক্ষমতাসীনেরা হয়তো লাভবান হবেন বলেই মনে করছেন; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য তা যে ইতিবাচক হবে না, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

অনেকেই প্রশ্ন করবেন, সরকার কী করতে পারত? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে সরকার সময় চেয়েছিল, কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা দিতে রাজি হননি। পেছনে ফেরার পথ নেই, কিন্তু এই প্রশ্ন তো করাই যায় যে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও সরকার-সমর্থকদের হামলার আগে কি এই আলোচনা শুরু করা যেত না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি এবং পুরো পরিস্থিতির সুযোগে উপাচার্যের বাসভবনে তাঁর ভাষায় ‘প্রশিক্ষিত দুষ্কৃতকারী’দের হামলার আগে কেন এ বিষয়ে আলোচনার তাগিদ ছিল না, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো যদি প্রধান লক্ষ্য হয়, যদি কোটা প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য সমাধান উদ্দেশ্য হয়, তবে রাজনৈতিক কৌশলে শিক্ষার্থীদের পরাস্ত করার ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। সে জন্য কোটা বাতিলের ঘোষণা পরিহার করে সংস্কারের জন্য কার্যকর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার দিকেই সরকারের মনোযোগ দেওয়া দরকার।

মনে রাখতে হবে, অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায় এবং বাংলাদেশের সংবিধানে সরকারের ওপর সেই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। সরকারি দল রাজনৈতিক কৌশলে পারদর্শিতা দেখাতে গিয়ে সেই দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আর এই সিদ্ধান্তের দায় আন্দোলনকারী তরুণদের ওপর চাপিয়ে দিতে যাঁরা ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠছেন, তাঁরা আশা করি ভেবে দেখবেন যে এই তরুণেরাই দেশের ভবিষ্যৎ।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
সূত্র : প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়