শিরোনাম
◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে

প্রকাশিত : ২৫ মার্চ, ২০১৮, ০৪:৩৩ সকাল
আপডেট : ২৫ মার্চ, ২০১৮, ০৪:৩৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মানব ইতিহাসের ভয়াল রাতের দুঃসহ স্মৃতি

মিঠুন মোস্তাফিজ : ২৫ শে মার্চের বিভীষিকাময় কালরাতে পাক হানাদাররা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলো ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে। যার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের টানা নয় মাস ধরে। তবে এই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে অসীম সাহসী বাঙালিও প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শত্রুর ট্যাংক- মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড। সেখান থেকে ভারী ট্যাংক ও সেনা বোঝাই লরিগুলো নল উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।

একে একে ইকবাল হল- এখনকার জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হলসহ সব হলেই হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পাননি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও।

এক রাতে তিন শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী শহীদ হন। অন্যদিকে নৃশংসভাবে শাহাদাৎ বরণ করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি নগরজুড়েও রাতভর চলে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংলীলা, তান্ডব। এ রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যা।

নয় মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে। মাত্র নয় মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই।

যা ঘটেছিল সেই কালরাতে:
সূর্য কেবলই ডুবল। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ মিনিট। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা বিমানবন্দরে চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া ধারাবাহিক বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়।

পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট বিমানে করাচি পাড়ি দিলেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে চোরের মতো করে পালিয়ে গেলেন।

কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারাদিন ধরে রোদেপোড়া নগরী চৈত্র্যের হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। তারপর দু’ঘণ্টাও গড়ায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাকবোঝাই দিয়ে সৈন্য ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা ছক অনুযায়ী পজিশন নিচ্ছে। গোলান্দাজ, সাঁজোয়া পদাতিক তিন বাহিনী থেকে বাছাই তিন ব্যাটালিয়ন ঘাতক।

রাত ১০টা ৩৫ মিনিট। নর্থ ঢাকায় সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল যা পরে শেরাটন ও এখনকার রূপসী বাংলা হোটেল ঘিরে ফেলেছে। ডিসিপশনে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন কমবয়সী ক্যাপ্টেন লিখে দিল বাইরে বেরুলেই গুলি। বিদেশী সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন।

না কার্ফিউয়ের কোন ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে তখন কানপাতা কঠিন হয়ে উঠেছে। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। কাঁচা ঘুমে জাগানো বারণ। ঢাকা-করাচি টেলিপ্রিন্টার লাইনও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচারও।

কেউ জানতেই পারেনি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে মার্কিন ট্যাঙ্ক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি।

ইকবাল হল (এখনকার জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানী হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। অসহায় নারী-পুরুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ।

চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। প্রতিটি রুমে রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জল্লাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ ছাত্রকে।

হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধার্ত শকুনরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; পাকি জান্তা সেই রাতে বাবার সামনে মেয়কে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে।

কাউকে কাউকে তারা সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোঁড়ার জন্য। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তে। তাদের দিয়েই একে একে সহপাঠীদের লাশ টানিয়ে এনে মাটিচাপা দিয়েছির পাক হায়েনারা। তারপরও শেষ রক্ষ হয়নি। কাজ শেষে তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়।

সেদিন রাতে একযোগে জগন্নাথ হল ছাড়াও ইকবাল হল, রোকেয়া হলে হায়েনার দল একে একে দানবের মতো হিংস্র থাবায় তছনছ করে দিয়েছিল সব। পাক জান্তার কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।

ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছঁড়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য মানুষকে।

চারদিক রক্ত আর রক্ত, সারি সারি শহীদের লাশ। সেদিন হিংস্র শ্বাপদ পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ ছাত্রী লাফিয়ে পড়েছিল। নরপশুরা সেদিন হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ প্রত্যক্ষ করেছিল শহরের সব জায়গায়।

সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশের সদর দফতরে পাকসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

কিন্তু শত্রুর ট্যাঙ্ক আর ভারি মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁডিয়ে যায় সমস্ত ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশের সদর দফতর। সে রাতে ১১শ’ বাঙালি পুলিশের রক্ত ঝরিয়েও তারা ক্ষান্ত হয়নি, গুঁড়িয়ে দেয় পুরো ব্যারাক, জ্বালিয়ে দেয় সবকিছু।

২৫ মার্চের সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তানি আক্রমণ অত্যাসন্ন, তখন শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীনকে ঢাকারই শহরতলিতে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন, যাতে ‘শিগগির তারা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন’। তারপর একনাগাড়ে প্রায় ৩৩ ঘণ্টা গোলাগুলির বিরামহীন শব্দে তাজউদ্দীনের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি, যে অনুমানের ভিত্তিতেই তাকে শহরতলিতে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে থাকুক, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে দলের কোনো নেতৃস্থানীয় সদস্যের সঙ্গে আলাপ-পরামর্শের সুযোগ তাজউদ্দীনের ছিল না। তা সত্ত্বেও পরবর্তী লক্ষ্য ও পন্থা সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে তাদের কোনো বিলম্ব ঘটেনি।

প্রথমতঃ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই।

দ্বিতীয়তঃ এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসেবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া। প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সব শেষে পাল্টা আঘাতের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে তাজউদ্দীন ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে হাজির হন ৩০ মার্চের সন্ধ্যায়। বাংলাদেশে তখন বিদ্রোহের অনল জ্বলছে। বিদ্রোহী সিপাহিদের পাশে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ একতাবদ্ধ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক ও খন্ডকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়