মো. কামাল হোসেন: খালেদা জিয়ার আইনজীবী লর্ড কারলাইল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের পর এক চিঠিতে তিনি মামলাটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। আরো অভিযোগ রয়েছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেন ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কারলাইল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক আলোচিত-সমালোচিত নাম লর্ড কারলাইল। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে যখন সারা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ তখন ঘাতকদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা ও যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখার পর লর্ড কারলাইল বাংলাদেশ সরকার বরাবর একটি চিঠি লিখেছিলেন।
চিঠিটি তিনি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌঁছে দেন। ওই চিঠিতে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং ওই আদালতের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার সুপারিশ করেন। তিনি লেখেন, ‘মামলাটি অসাঞ্জস্যতায় পরিপূর্ণ, একপেশে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপপূর্ণ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো মান না মেনেই প্রতিষ্ঠিত।’
এছাড়া ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর জামায়াতের ওয়েবসাইটে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে লেখা সাবেক সৌদি কূটনীতিক ড. আলী আল ঘামদির লেখায়ও তার প্রসঙ্গ রয়েছে। ২০১৩ সালের ১৯ অক্টোবর যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন কারলাইল। জামায়াতের ওয়েবসাইটে তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল সময়েও (২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর) যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি না দিতে আহ্বান জানান এই লর্ড।
গত মঙ্গলবার (২১ মার্চ) বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য ব্রিটেনের এক আইনজীবীকে নিয়োগ দিয়েছে বিএনপি। তিনি খালেদা জিয়ার ৩৬টি মামলায় পরামর্শ ও সহযোগিতা করবেন। মঙ্গলবার দুপুরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই কথা জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এসময় মির্জা ফখরুল জানান, বিদেশী এই আইনজীবীর নাম লর্ড কারলাইল। ব্রিটেনে যারা আমাদের রাজনীতির সমর্থক রয়েছেন তাদের সাথে আলোচনা করে এ ব্রিটিশ আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী বিদেশী কোন আইনজীবী দেশের আদালতে মামলা পরিচালনা করতে পারবেন না। তবে আইনি পরামর্শ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০০৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা হলে সেখানেও ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরী ব্লেয়ারকে বিদেশী আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিলো।
লর্ড কারলাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, চট্টগ্রামের কসাইখ্যাত কুখ্যাত মীর কাশেম আলীর ফাঁসির দণ্ডাদেশ বাতিলের জন্য জাতিসংঘে জোর লবিং করেছিলেন তিনি। এ নিয়ে তার একটি বিবৃতি ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসের স্বতন্ত্র সদস্য কারলাইনের প্রতিক্রিয়ামূলক লেখালেখিও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ হাউস অব লর্ডসের স্বতন্ত্র সদস্য কারলাইল ব্রিটেনের শীর্ষ আইন বিশেষজ্ঞদের অন্যতম। পোলিশ ইহুদি অভিবাসী পরিবারে তার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে আইনে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন ১৯৬৯ সালে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি ‘কুইন’স কাউন্সেল (কিউসি)’ নিযুক্ত হন। লর্ড কারলাইল একজন ব্যারিস্টার এবং লন্ডনের শীর্ষস্থানীয় ব্যারিস্টারদের চেম্বার ‘ফাউন্ড্রি চেম্বারসের সাবেক প্রধান।
নির্বাসিত বা নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর বিষয়ে লর্ড কারলাইলের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এ ধরনের এমন অনেক প্রতিষ্ঠান তার পরামর্শ নিয়ে থাকে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক সংগঠনকে আমেরিকায় আইনি ভিত্তির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নির্দেশনা দেওয়া ছাড়াও মার্কিন আইনজীবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি আইনজীবী ও কর্মকর্তাদের কাছে সংগঠনটির আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন তিনি।
সাধারণত গুরুতর অপরাধ, স্থানীয় সরকার এবং লাইসেন্স, পরিকল্পনা ও পেশাগত নিয়ম-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সরকারি আইনের মামলায় বেশি অংশ নিয়ে থাকেন লর্ড কারলাইল। সংসদীয় অধিকার ও আচরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এছাড়া বড় ধরনের বাণিজ্যিক প্রতারণার মামলায়ও পারদর্শী তিনি। এমন অনেক মামলায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে তাকে।
এছাড়া লর্ড কারলাইলব্রিটিশ গোয়েন্দা সেবা প্রতিষ্ঠান এম-সিক্সটিনের সাবেক প্রধান স্যার জন স্কারলেটের সঙ্গে মিলে কৌশল ও রাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান এসসি স্ট্র্যাটেজি লিমিটেড পরিচালনা করছেন লর্ড কারলাইল।
সম্প্রতি কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন লর্ড কারলাইল। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার বণ্টন নিয়ে গভীর আগ্রহ রয়েছে এই সংস্থার। তিনি নিজেও এই বিষয়ে অনেক আগ্রহী।
২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের স্বাধীন পর্যবেক্ষক ছিলেন দেশটির এই আইনজীবী। জাতীয় নিরাপত্তায় অবদানের জন্য ২০১২ সালে তাকে সম্মানসূচক কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (সিবিই) নিয়োগ দেওয়া হয়।
মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক মামলায়ও লর্ড কারলাইলের বেশ আগ্রহ রয়েছে। হাভার্ড লিগ ফর পেনাল রিফর্মের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০৬ সালে বেশকিছু তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। তাকে ওই সময় জেলখানায় শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ওপর নির্যাতন, ফাঁদ অনুসন্ধান ও শিশুদের বিভিন্ন মামলা তদন্ত করতে হয়েছিল।
লর্ড কারলাইল পেশাগত জীবনে রাজনীতিক হিসেবেও সফল। ওয়েলসের লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক দলের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও ১৯৮৩ থেকে ’৯৭ পর্যন্ত মন্টোগমেরিশায়ার এলাকা থেকে পার্লামেন্ট মেম্বারের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। ১৯৯২ সালে দলের বেহাল অবস্থায় নেতৃত্বে এসেছিলেন তিনি। এরপর ওয়েলসের লেবার পার্টির সঙ্গে দায়িত্ব হস্তান্তরের আলোচনার অন্যতম ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেন এই আইনজীবী। ১৯৯৭ সালে ক্ষমতা বিষয়ে গণভোটের ব্যাপারেও নেতৃত্ব দেন তিনি।
২০১৭ সাল পর্যন্ত লিবারেল ডেমোক্রেটিক দলের সম্মানিত সদস্য থাকাকালে জাতীয় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলীয় নীতির সঙ্গে বিরোধ হয় কারলাইলের। এ কারণে দল থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। সেই সময়ের খবরে বলা হয়েছিল— বেসামরিক স্বাধীনতা বিশেষ করে তথাকথিত ‘স্নুপারস চার্টার্স’ বিষয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিরোধের কারণেই দল ছাড়েন তিনি।
ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, হাইকোর্টের সহকারী বিচারক, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন লর্ড কারলাইল। হোয়াইট অ্যাসাইন অ্যাসোসিয়েশনের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য তিনি। ২০০৬ সালে হাভার্ড দণ্ডবিধি সংস্কার কমিটির সভাপতি পদেও পাওয়া গেছে তাকে। প্রথম সংসদ সদস্য হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি।
কারলাইলের নিয়োগ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলার মধ্যে একটি মামলায় বেআইনি ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। লর্ড কারলাইল দীর্ঘদিন ধরে আইনি পেশার পাশাপাশি রাজনীতির সাথেও জড়িত। লর্ড কারলাইল খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনায় আইনজীবী টিমের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরে আনন্দিত। এখন থেকে লর্ড কারলাইল দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলায় পরামর্শ ও সহযোগিতা করবেন। প্রয়োজনে তিনি বাংলাদেশেও আসবেন।
এব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে লর্ড কারলাইল এমন কোনো অবস্থান নিয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ আজ বলেন, লর্ড কারলাইল আইসিটি নিয়ে বিদ্বেষমূলক অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি এ সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা একটি স্বাধীন দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি হস্তক্ষেপের শামিল।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, আমি ভেবেছিলাম জামায়াতে ইসলামী তাকে ভুল বুঝিয়েছে, কিন্তু পাচঁ বছর আগে তার সাথে দেখা হওয়ার পরে মনে হল, সে জামায়াতে ইসলামীর টাকায় পরামর্শ দেন। এটা লজ্জাজনক।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গত সপ্তাহে ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলাদেশবিষয়ক সেমিনার আয়োজন করে আলোচনায় এসেছেন লর্ড কারলাইল। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা অংশ না নেওয়ায় সেটি কার্যত বিএনপি ও জামায়াতের একতরফা অভিযোগ জানানোর মঞ্চে পরিণত হয়। এছাড়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের শুরু থেকেই কারলাইল ছিলেন তার বিরোধী। ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের ভূমিকাকে ‘প্রতিশোধমূলক’ বলে অভিযোগ করে দক্ষিণ আফ্রিকা ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের মতো ‘ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের নীতি’ অনুসরণ করার আহ্বান জানান কারলাইল।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখার পর ২০১৫ সালের ১৭ জুন লন্ডনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিবারেল ডেমোক্র্যাট নেতা ও সিনিয়র আইনজীবী লর্ড কারলাইল কিউসি বলেন, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট মুজাহিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখায় আমি গভীরভাবে হতাশ হয়েছি। কেননা মুজাহিদের এই মামলা এবং ইতোপূর্বে বিচার সম্পন্ন হওয়া আবদুল কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া মোটেও আন্তর্জাতিক বিচারে মানসম্মত ছিল না। তার এমন প্রতিক্রিয়া ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। সূত্র: প্রথম আলো
আপনার মতামত লিখুন :