শিরোনাম
◈ চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১২ ইউনিট ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১৪ মার্চ, ২০১৮, ০৫:৩৩ সকাল
আপডেট : ১৪ মার্চ, ২০১৮, ০৫:৩৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ফিরে দেখা পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং- এর জীবনী

রবিন আকরাম : গ্যালিলিও গ্যালিলাই-এর মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছর পরে, ১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি স্টিভেন হকিংয়ের জন্ম। তার বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসোবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী। হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন। লন্ডনে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। হকিং গর্ভে আসার পর নিরাপত্তার খাতিরে তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। হকিংয়ের জন্মের পর তাঁরা আবার লল্ডনে ফিরে আসেন। ফিলিপ্পা ও মেরি নামে হকিংয়ের দুই বোন রয়েছে।

এছাড়া হকিং পরিবারে এডওয়ার্ড নামে এক পালকপুত্রও ছিল। হকিংয়ের বাবা-মা পূর্ব লন্ডনে বসাবস করলেও ইসাবেল গর্ভবতী থাকার সময় তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। সে সময় জার্মানরা নিয়মিতভাবে লন্ডনে বোমাবর্ষণ করতো। হকিংয়ের একটি প্রকাশনা থেকে জানা গেছে তাদের বসতবাড়ির কয়েকটি গলি পরেই জার্মানির ভি-২ মিসাইল আঘাত হানে।

স্টিভেনের জন্মের পর তাঁরা আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। সেখানে স্টিভেনের বাবা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ হকিংদের পরিবার হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবাতে চলে যান।

স্টিফেন হকিং ছোটবেলা থেকেই খুব একটা ভালো ছাত্র ছিলেন না। তবে বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ থাকায় শিক্ষক ও বন্ধুরা তাকে খুব ভালোবাসতেন।

স্টিফেন হকিং বিশিষ্ট ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাকে বিশ্বের সমকালীন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। হকিং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে ১ অক্টোবর, ২০০৯ তারিখে অবসর নেন।

এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের গনভিলি এবং কেয়াস কলেজের ফেলো হিসাবে কর্মরত ছিলেণ। শারীরিকভাবে ভীষণরকম অচল এবং এ.এল.এসের (এমায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস বা লাউ গেহরিগ রোগ- যা একপ্রকার মোটর নিউরন রোগ) জন্য ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অথর্বতার দিকে ধাবিত হওয়া সত্ত্বেও বহু বছর যাবৎ তিনি তাঁর গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের দুইটি অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরাজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব ব্ল্যাক হোল-এর ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে (অথবা কখনো কখনো বেকেনস্টাইন-হকিং বিকিরণ) অভিহিত। প্রায় ৪০ বছর ধরে হকিং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা করছেন।

লিখিত পুস্তক এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির থেকে হকিং একাডেমিক জগতে যথেষ্ট খ্যাতিমান হয়ে উঠেন। তিনি রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য। ২০১৪ সালে তাকে নিয়ে একটি মুভি তৈরি হয়, নাম থিওরি অব এভরিথিং।

হকিংয়ের অসু্স্থতা ধরা পড়ে ১৯৬৩ সালে। মোটর নিউরন ডিজিজ ধরা পড়ার পর অনেকটা ভেঙে পড়েন তিনি। তখন বেঁচে থাকতে অনুপ্রেরণা দিয়ে সহায়তা করেছিলেন তার স্ত্রী জেন। কিংয়ের চিকিৎসাও শুরু হয় সে সময় থেকে।

১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে জেনেভার সার্ন-এ অবস্থানকালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী। তার অবস্থা সে সময় এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হয়। এরপর তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। চিকিৎসকরাও তাঁর কষ্ট দেখে একসময় লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ৷ সাপোর্ট বন্ধ করলেই তার নিশ্চিত মৃত্যু হতো।

হকিংয়ের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের প্রায় ২০ বছর পর তিনি এক সাক্ষাৎকারে তার জীবনের ‘অন্ধকার’ সময়ে স্ত্রী জেনের সেই প্রাণ বাঁচানো সহায়তার কথা জানান।

হকিংয়ের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে এক তথ্যচিত্র। সেখানেই এই তথ্য জানিয়েছেন হকিং। তিনি বলেছেন, ‘নিউমোনিয়ার ধকল আমি সহ্য করতে পারি নি, কোমায় চলে গিয়েছিলাম। তবে চিকিৎসকরা শেষ অবধি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন , হাল ছাড়েননি ৷’

সে সময় চেষ্টা সত্ত্বেও হকিংয়ের অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চিকিৎসকরা হকিংয়ের স্ত্রী জেনকেও লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানান।

হকিংয়ের স্ত্রী জেন অবশ্য সে প্রস্তাবে রাজি হননি। এরপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন হকিং। সে সময় হকিংয়ের লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করে দিলে এ বিশ্ব হয়ত বহু জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হত।

প্রায় পাঁচ দশক ধরে মোটর নিউরন ব্যাধির শিকার জগৎখ্যাত এই পদার্থবিদ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগে আক্রান্তরা প্রায় পাঁচ বছর বাঁচেন। তবে হকিং এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সবকিছুর ছেড়ে শেষ পর্যন্ত তাকে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে। ৭৬ বছর বয়সে ১৪ মার্চ ২০১৮তে মৃত্যু বরণ করেন স্টিফেন হকিং।

 

হকিং সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য:-

১. স্টিফেন ছিলেন খারাপ ছাত্র, যখন তার বয়স নয় বছর তখন তিনি ছিলেন ক্লাসের সর্বশেষ মেধাক্রম ছাত্র। অর্থাৎ পিছনের দিক থেকে প্রথম।

২. তাঁর প্রাথমিকের পাঠ শেষ হয় লন্ডনে। পরে সেন্ট অ্যালবেন্সে চলে যায় তাঁক পরিবার।

৩. ১৯৫২ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তাঁর বাবাও।

৪. ছাত্র হিসাবে খুব মেধাবি ছিলেন না হকিং। বিভিন্ন সময় পড়াশুনোয় মনোনিবেশ করাতে তাঁকে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে।

৫. গণিত নিয়ে পড়াশুনো করার ইচ্ছা থাকলেও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে গণিত বিভাগ না থাকায় পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেন তিনি।

৬. ১৯৬৫ সালে জিন বিল্ডের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। দম্পতির ৩টি সন্তান রয়েছে। ১৯৯৫ সালে বিল্ডের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় হকিংয়ের।

৭. ১৯৯৫ সালেই অ্যালেন মেসনকে বিয়ে করেন হকিং। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই বিয়ে টিকেছিল। বিয়ের পরই পূর্বপত্নীর বিরুদ্ধে শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ তোলেন হকিং। যা নিয়ে বিস্তর জলঘোলাও হয়।

৮. ১৯৬২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করেন হকিং। ১৯৬৫ সালে তিনি গবেষণা শেষ করেন। ১৯৬৯ সালে ফেলো ফর ডিস্টিংশন ইন সায়েন্স হন তিনি।

৯. মহাজাগতিক পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের অবতারণা করেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে হকিং রেডিয়েশন, প্যানরোজ - হকিং তত্ত্ব, বেকেনস্টাইন - হকিং ফরমুলা, হকিং এনার্জি, গিবসন - হকিং স্পেস ও গিবসন - হকিং এফেক্ট।

১০. ১৯৬৩ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে মোটর নিউরোন রোগে আক্রান্ত হন স্টিফেন হকিং। চিকিত্সক জানান, মাত্র ২ বছর আয়ু তাঁর। কিন্তু পরে চিকিত্সকরা জানান ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচতে পারেন তিনি। তবে সব অনুমানকেই মিথ্যে করে দিয়েছে তাঁর জীবনীশক্তি।

১১. হকিংয়ের বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তারি পড়বে নয়তো অক্সফোর্ডে পড়বে কিন্তু টাকার জন্য পড়া হয়নি। হকিং তাই অংশগ্রহন করলেন স্কলারশিপ পরীক্ষায় এবং টিকেও গেলেন সফলতার সাক্ষর রেখে।

১২. ভার্সিটি জীবনে হকিং প্রথম অবস্থায় ছিলেন অনেক বেশি নিঃসঙ্গ। তাই একাকীত্ব দূর করতে যোগ দিয়েন কলেজের বোট রেসিং টিমে। সমচেয়ে মজার খবরটি হলো রেসিং টিমে তার দায়িত্ব ছিল রেসের সময় নৌকায় হাল ধরে রাখা। আর এই কাজটি তিনি এতো সফলভাবে করেছেন যে অল্প কিছুদিনের হয়ে উঠেছিলেন পুরো অক্সফোর্ডে বিপুল জনপ্রিয়। সপ্তাহে ছয়দিন তাকে প্র্যাকটিস করতে হতো বোট চালানোর। যা তার পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল।

১৩. গ্রাজুয়েশন শেষ করে ক্রিসমাসের শুটিতে বাড়িতে আসতেই পরিবারের লোকজন তার অসুস্থাতার বিষয়টি খেয়াল করেন। সেই সময় নিউ ইয়ার পার্টিতে দেখা হয় জেনির সাথে। তার একু্শ সপ্তাহের পর ডাক্তারের পরিক্ষায় তিনি জানতে পারেন তিনি ল্যাটেরাল স্কেলেরিওসিস এ আক্রান্ত। তখন তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় কারণ তাকে বলা হয়েছিল তার বেঁচে থাকার সময় মাত্র কয়েকবছর। কুন্তু সেখানে লিউকেমিয়ায় মরণাপন্ন এক শিশুকে দেখে তিনি ফিরে পান বেঁচে থাকার প্রেরনা। তাই জেনিকে নিয়ে শুরু হয় প্রণয় জীবণের।

১৪. ২০০৭ সালে স্টিফেন হকিং তার মেয়ে লুসি হকিং-এর সাথে মিলে লিখেছেন ছোটদের বই 'George's secret key to the universe' যা জর্জ নামের ছোট বালকের কাহিনী যাতে রয়েছে ব্ল্যাকহোলসহ নানা বৈজ্ঞানিক ধারণা। ২০০৯ সালে বের হয়েছে এই বইয়ের পরবর্তী পর্ব।

বিভিন্ন অবদানের জন্য পাওয়া তার উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে প্রিন্স অব অস্ট্রিয়ানস পুরস্কার, কোপলি পদক, এডিংটন পদক, হিউ পদক, আলবার্ট আইনস্টাইন পদক, উলফ পুরস্কার, জুলিয়াস এডগার লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়