ডেস্ক রিপোর্ট : অভিনেতা শাহেদ আলী ও অভিনেত্রী দীপা খন্দকার ছোট পর্দার দুই প্রিয়মুখ। দুই সন্তান আদ্রিক-আরোহীকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। নিজেদের ভালোবাসা ও সংসার জীবনের গল্প শুনিয়েছেন শাহেদ-দীপা।
প্রথমেই শাহেদ আলী ও দীপা খন্দকারের কাছে জানতে চাওয়া হলো, ভালেবাসার সংজ্ঞা কী? শাহেদ বলেন, ‘ভালবাসা শব্দের অর্থ হচ্ছে একটি ভালো বাসা, সে বাসায় যারা থাকেন তারা সকলেই থাকেন একটা সুশোভিত বন্ধনের মধ্যে।’
দীপার মতে, ‘ভালোবাসা মানে বিশ্বাস বা বন্ধন। বন্ধন কিংবা বিশ্বাস না থাকলে তো আর কিছুই থাকে না। আমি মনে করি প্রেম-রোমাঞ্চ বলে কিছু নেই। আমার কাছে বন্ধনটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে জীবন কাটানোটাই হচ্ছে ভালোবাসা।’
প্রথম পরিচয়:
প্রায় দেড় যুগ ধরে মঞ্চে অভিনয় করছেন শাহেদ। প্রাচ্যনাটের অন্যতম সদস্য তিনি। প্রাচ্যনাটের এ্যাকটিং স্কুলে কোর্স করতে গিয়েই শাহেদকে প্রথম দেখেছিলেন দীপা। দীপা বলেন, ‘সেটা অনেক বছর আগে। সেই পরিচয় বিশেষ কোনো পরিচয় না। আর দশজনের সঙ্গে প্রতিনিয়তই আমরা যেমন পরিচিত হই সেটা ছিল তেমনই।’
বধূ কোন আলো লাগল চোখে:
২০০৬ সালের ১৬ ও ১৭ মে। এই দুইদিন ছিল তাদের ভালবাসার টার্নিং পয়েন্ট। পুরো ব্যাপারটাই ছিল অন্যরকম। শোনা যাক দীপা খন্দকারের কাছে, তিনি বলেন, ‘একটি নাটকের শুটিং ছিল। আমরা দুইদিন একসঙ্গে শুটিং করেছি। তবে মজার ব্যাপার হল, এই দুইদিন শুটিংয়ের বাইরে অন্য কোনো কথাই হয়নি আমাদের। তারপর কীভাবে কী হল কিছুই বুঝিনি। শুটিং শেষ করে বাসায় এসে ওকে মিস করেছি অনেক। আমার মনে হয়েছে, স্রষ্টা আমাদের জোড়া মিলিয়ে রেখেছিলেন বলেই এমন হয়েছে।’
প্রেম বলে কিছু নেই:
নাটকের নাম ‘প্রান্তিক’। গিয়াসউদ্দিন সেলিমের পরিচালনায় এ নাটকে অভিনয় করেছিলেন দীপা খন্দকার। তখন রীতিমতো জনপ্রিয় অভিনেত্রী তিনি। অন্যদিকে শাহেদ মঞ্চ থেকে কেবল ছোট পর্দায় এসেছেন। এই নাটকের ডায়ালগ হিসেবেই শাহেদ আলী প্রাণ খুলে গাইলেন, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই…।’ আর এই গান শুনে দীপার নজরকাড়া হাসি। শাহেদ বললেন, ‘এই হাসি আমার মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল এই হাসিটা অভিনয়ের হাসি না। এরপর যা হয়েছিল সেটা হচ্ছে শুটিং শেষ করে দীপা তার গাড়ি নিয়ে শুটিং স্পট থেকে বেরিয়ে গেছে। আমি সাধারণত শুটিং শেষ করে বিদায় নেওয়ার সময় কো-আর্টিস্টদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করি। বিদায় নিই। কিন্তু এইবার দীপার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া হল না। বাসায় আসার পর খেয়াল করলাম আমার কোনো কিছু ভাল লাগছে না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই হাসি।’
এমনটি আগে কখনোই হয়নি শাহেদের। দীপার বেলাতেও নাকি ঘটেছিল এমনই। দীপা বললেন, ‘আমি অনেক অনেক কো-আর্টিস্টের সঙ্গে অভিনয় করেছি। কিন্তু ওইদিন বাসায় ফেরার পর খেয়াল করলাম, আমি শাহেদকে ভুলতে পারছি না। এরপর পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম ভাইকে ফোন করে ব্যাপারটি খুলে বলি। ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি শাহেদকে বিয়ে করব কি না? আমি অকপটেই বললাম, হ্যাঁ বিয়ে করব।’
নয়দিন বাদেই বিয়ের বাদ্য:
শুটিং থেকে ফিরে আসার নয়দিন বাদেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন শাহেদ-দীপা। দিনটি ছিল ২৭ মে ২০০৬। বাংলামটরে একটা রেস্টুরেন্টে হয়েছিল বিয়ের আয়োজন। দিনটি স্মরণে রাখার মতোই একটি দিন। বেশ কিছু মজার ঘটনা ঘটে এই দিনে।
সবাই সবার অচেনা:
শাহেদ চেনেন দীপা খন্দকারকে। আর দীপা চেনেন শাহেদ আলীকে। এ ছাড়া উভয় পরিবারের কেউ কাউকে চেনেন না। দীপা খন্দকারের মা তো ভড়কে গিয়েছিলেন নিজের জামাইকে দেখে। মেয়ে এ কেমন বর পছন্দ করেছে মাথায় পাখির বাসার মতো চুল! মুখভর্তি এলোমেলো দাড়ি। এরপর আবার বরের মাথায় পাগড়ি নেই। তারপরও মেয়ের পছন্দ বলে কথা। বেশ গুছিয়েই বিয়ে হয়। এ প্রসঙ্গে শাহেদ বললেন, ‘কিছুদিন আগে আমাদের বিয়ের ছবি দেখে আমার ছেলে আদৃক প্রশ্ন করেছে, বাবা তুমি বিয়েতে পাগড়ি পরোনি কেন? আমি তাকে কী উত্তর দেব! আগে যদি জানতাম ছেলে এমন প্রশ্ন করবে তাহলে অবশ্যই বিয়ের পাগড়ি পরতাম। দুটি জিনিস আমি কখনোই ভাবতে পারতাম না। একটা হচ্ছে, আমি মটরসাইকেল চালাচ্ছি পেছনে কোনো মেয়ে বসে আছে। আর দ্বিতীয়ত আমি বর সেজে বসে, পাশে একটা মেয়ে। এখনো আমি মটরসাইকেল চালাই না। বিয়ে একবার করেছি আর কখনোই বিয়ে করতে চাই না।’
বিয়ের পরের বিড়ম্বনা:
বিয়ের দিনের ওই বিড়ম্বনা পরে আর হতে দেননি শাহেদ-দীপা। কিন্তু সেখানে আরেক বিড়ম্বনা। বিয়ের পরেই ক্লিনড শেভ আর চুলও ছোট করে স্যুটেড বুটেড শাহেদ শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেলে আবারও বিড়ম্বনার শিকার হন। অনেকেই বলেছিলেন, দীপা নাকি একজনকে বিয়ে করেছেন আর সঙ্গে নিয়ে এসেছেন অন্য আরেকজনকে। অনেকেই আড়াল-আবডাল থেকে বিয়ের দিনের ছবির সঙ্গে এই শাহেদকে মিলানোর চেষ্টা করেছেন।
নতুন জীবনের বোঝাপড়া
তাদের বিয়েটা দীর্ঘদিনের প্রেমের বিয়ে নয়। তাই বিয়ের পরই শুরু হল দুজন দুজনকে কাছাকাছি থেকে চেনা ও বোঝার পালা। দীপা বললেন, ‘বিয়ের পর বোঝাপড়ার জন্য দুজনের সময় নেওয়া উচিত। বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত আমি একা বিছানায় ঘুমিয়েছি। আমার পাশে একটা ছেলে ঘুমাবে— এটা ভাবতেই আমার কেমন যেন লাগত। আমি মাঝে মধ্যেই কে কে বলে চিৎকার করে উঠতাম। ভাবতাম আমার পাশে কে ঘুমিয়ে আছে?’
দেড় বছর পর হানিমুন:
অবাক করা বিষয়, বিয়ের প্রায় দেড় বছর পর হানিমুনে যান শাহেদ-দীপা। বিয়ের পর অনেকদিন একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া হয়নি কোথাও। দীপার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘প্রথম একসঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি আমাদের ছেলে আদৃক জন্ম নেওয়ার পর। ২০০৭ সালের ১২ ডিসেম্বর আমাদের ঘরে আসে আদৃক। আমরা গিয়েছিলাম কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন পরে বান্দরবান, খুলনা ও বাগেরহাট। প্রথমে বাংলাদেশটা ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছি। পরে ভুটান, নেপাল, ব্যাংকক, ইন্ডিয়াসহ দেশের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। এখন আমাদের মেয়ে এসেছে। তাকেসহ আরও অনেক জায়গায় বেড়ানোর ইচ্ছা আছে।’
ভালোবাসায় সাজানো একটা বাগান
ছোট্ট একটা ঘর। ঠিক যেন ঘর নয়, ফুলের বাগানের মতো। বাবা-মা ফুলের গাছ। আর ছেলেমেয়েরা নয়নতারা ফুল। ঠিক এমনই এক গোছানো সংসার হয়েছে তাদের। ছেলে আদৃক ও মেয়ে আরোহীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ভালোবাসার দৃঢ়বন্ধন। ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে সাজানো সংসারে আনন্দে কাটছে তাদের জীবন।
মিল-অমিল:
জীবনে মিল-অমিল থাকবেই। আর প্রত্যেকটি মানুষেরই থাকে নিজস্ব ভাবনা। প্রথমেই শাহেদের কাছে জেনে নিই তাদের মিল-অমিলগুলো। শাহেদ বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বেশি মিল হচ্ছে, আমরা দুজনই খুব বন্ধু বৎসল, আমরা দুজনই খুব স্টেট ফরোয়ার্ড, আমরা দুজনই ঘরমুখী। আর অমিল হচ্ছে দীপা খুব বুদ্ধিমতী, আমি তার মতো বুদ্ধিমান না। সে অনেক গোছানো মানুষ। আমি তার তুলনায় কম গোছানো। দীপা অনেক জ্ঞানী মানুষ— আমি অনেক মাথা গরম মানুষ।’
একজন অপরজনকে ছাড়া:
শাহেদ-দীপা পরস্পরের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন। শুটিং ছাড়া তাদের একা তেমন-একটা দেখা যায় না বললেই চলে। সব সময় একসঙ্গেই বেড়াতে পছন্দ করেন তারা। কোনো দাওয়াত কিংবা আড্ডাতেও তাদের দেখা যায় জুটিবদ্ধভাবেই।
সংসারের নিত্যদিনের সঙ্গী:
পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী হচ্ছে ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্য— যা সম্পর্ককে মধুর করে তোলে। মাঝে মধ্যে অবশ্য হিতে বিপরীত হয়। এ প্রসঙ্গে দীপা খন্দকার বলেন, ‘এই জিনিসটা আমাদের মধ্যে একটু বেশিই হয়। তবে মন খারাপ করে আমরা কথাবার্তা বলা কখনোই বন্ধ করি না। সংসারের কাজকর্ম চলতে থাকে তার নিয়ম মতো। বাজার-হাট-রান্না সবই চলে ঠিকমতোই। আমার আট বছরের সংসার জীবনে রাগ করে কখনোই বাবার বাড়ি যেতে হয়নি। আর সুজন (শাহেদ আলীর ডাক নাম) রাগ করে কখনোই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়নি। সংসারে ঝগড়া হতেই পারে। কিন্তু সারাটা জীবন তো আমাদের একসঙ্গেই থাকতে হবে। সব মিলিয়েই আমরা এখন অনেক ভাল আছি।’
ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবনা:
দীপা-শাহেদ ছেলেমেয়েদের নিয়ে কী ভাবছেন? দীপা বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের ওপর আমরা কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। তারা যা হতে চায় তাই হবে। আদৃক কণ্ঠশিল্পী হতে চায়। সে যদি ভাল গান গাইতে পারে, তাকে আমরা পুরো সাপোর্ট দেব। আমার মা আমাকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তো ডাক্তার হইনি। অভিনেত্রী হয়েছি।’
বিয়ের পর আট বছর যৌথ পরিবারে কাটিয়েছেন তারা। শাহেদ-দীপা দুজনই মনে করেন, স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে পরিবার নয়, বরং বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন সব মিলিয়েই পরিবার। তাই সুযোগ পেলেই সবাই মিলে বেড়াতে চলে যান কাছের আত্মীয়দের বাসায়।
আপনার মতামত লিখুন :