দীপক চৌধুরী: রাজনীতি হোক মানুষের জন্য, মানুষের শান্তির জন্য, মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য নয়।' ডিমবিক্রেতার মুখ থেকে এমন কথা শুনে তাঁর চোখমুখের দিকে তাকাই। এবার আমার বাজার ব্যাগে চোখ বুলিয়ে তাঁর প্রশ্ন, 'নিবেন স্যার? ডিমের দাম এখন কম।' শুক্রবারের বাজার, যথেষ্ট ভিড়। মনভরে বাজার করার আনন্দ বইছে ভেতর। শুরুতেই ডিম নিয়ে দামদর করতে চাই না। শুধু জানতে চাই, ' ডজন কত?
' মাত্র ৭৫ টাকা, লাল ডিম। হাঁসের ডিম ১২৫, মুরগীর ডিম ১৩৫ টাকা। কোনটা নেবেন?'
'দাম কমে না?'
' কী যে কন, দুই বছর আগেও ফার্মের লালডিমই ছিলো ১১০টাকা।'
ডিমের প্রসঙ্গ চেপে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, 'ভাই, রাজনীতির কথা শুনছিলাম আপনার মুখ থেকে। বিক্রি করেন ডিম, আলাপ করেন রাজনীতির? বিষয়টা কী?'
' মাইন্ড করবেন না ভাই, '১৪ সালের কথা। ভাইটা বাসের ভেতর পেট্রলবোমায় পুড়ে মরেছে। রাজনীতি করতো না, কারো সাত- পাঁচে ছিল না। হে তো মারা গেছেই, পরিবারটা এখন মরা। ভাইটার বিধবা বউ দেশ থেকে ভোরে এসেছে। টাকা চায়, সাহায্য চায়। আর কই যাবে? এই কথাটাই আলাপ করছিলাম 'লগেরজনের' সঙ্গে।' ডিমওয়ালা পাশের লোকটিকে মাথা নেড়ে দেখায়।
আমি কী বলবো খুঁজে পাই না। ডিমওয়ালা বলে, ' ভাইসাহেব, মানুষের জন্য রাজনীতি করলে এইরকম পোড়াইয়া মারতে হইতো না, ওরা মানুষের শান্তি চায় না; ক্ষমতা চায়।' কীসের ডিম নিয়ে দরদাম করবো! ভাবি লোকটির কথা, রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা, রাজনীতির কথা, দেশপ্রেমের কথা।
এবার ডিমের কথায় আসি। অবাক হই, আমাদের দেশে হাঁসের ডিমের ডজন ১২০ টাকা। ওই ডিমই ইন্ডিয়া ৪৫ টাকায় বিক্রি হয় কীভাবে? ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, তামিলনাডু এসব জায়গায় এই সেদিন ঘুরে এসেছি। সেখানকার বাজারগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ ছিলো। ডিমের স্বাদও মোটেই কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ডলার মূল্যে ইন্ডিয়ার ৪৫ টাকা সমান বাংলাদেশের মুদ্রায় ৫৫ টাকা। ভারত যদি পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন?
আমার মনে হয়, সবকিছুকেই আমরা রাজনীতিকরণ করে ফেলি। মানুষের মৃত্যু ননিয়ে, শিশুর লাশ নিয়ে। চেন্নাইয়ে দেখেছি প্রতিটি গ্রামীন বাড়িতেই হাঁস-মুরগী পোষা হয়। যে কেউ আগ্রহ দেখালে এ সুযোগ পান। প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি সবরকম সুবিধা পান, ঋণও পান। প্রতিটি বাড়িতেই দেখলাম ছোটখাটো ডেইরি ফার্ম। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের প্রচারে কান ঝালাপালা হয়ে যায়, বাস্তবে নেই।
এখন তো মার্চ। আমাদের স্বাধীনতার মাস। একটি তথ্য জানিয়ে শেষ করবো লেখাটি। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতার কথা এখানেও পাই। তাঁকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। যে ভাষণ মানষকে শিহরিত করে। তিনি সেই চল্লিশের দশকেই দিল্লী ও পাঞ্জাবের পথে কার্নালে ডেইরি রিসার্চ ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করেছিলেন। আজকের বহুল প্রচারিত মিল্কভিটা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হাতেই তৈরি। তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করতেন। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখলে আজ আমরাও ৪৫ টাকা ডজন ডিম খেতে পারতাম।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গল্পকার
আপনার মতামত লিখুন :