শিরোনাম
◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৬:০৬ সকাল
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৬:০৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘বেজে ওঠে সাইরেন’ এবং বইয়ের পাঠক

আনিস আলমগীর : বইমেলা আমাকে আর আকর্ষণ করে না। এমন কি নিজের বই প্রকাশিত হলেও প্রকাশনার দিন ছাড়া বইমেলায় ৫ দিন যাওয়া হয় কিনা সন্দেহ। অথচ ইন্টারনেট যুগের আগে প্রতিদিন বইমেলায় না গেলে কী যেন মিস হয়ে যাচ্ছে অনুভব হতো। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, বইকেনা, লেখকদের সঙ্গে দেখা—কিছুই বাদ যেত না। তারপরও বলতে হয়, প্রতি বছর এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে, ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এখনও জমে উঠে বইয়ের বাজার। লেখক, প্রকাশক সবাই এ সময়টাকে টার্গেট করেন নিজস্ব প্রকাশনাকে, সৃষ্টিকে বাজারে আনার জন্য।
প্রচুর মানুষ মেলায় যায়। আড্ডা মারতে যায়, বই কিনতে যায়, বিনোদন পেতে যায়। প্রকাশকদের আমি কখনও শুনি না বিক্রি ভালো হয়েছে বলতে। কিন্তু মানুষ বই না কিনলে তারা হাজার হাজার বই মেলাকে ঘিরে প্রকাশ করেন কেন! নিশ্চয়ই কেনে। পড়ার টানটা হয়তো কেউ কেউ বলবেন আগের মতো না। আমরা কেউই আগের মতো বই পড়ি না। কিন্তু কেউ কি প্রশ্ন করেছেন- আগের মতো বই পড়ার সময়টা কোথায়? পড়ার মতো বই প্রকাশিত হচ্ছে কয়টা? যারা লিখছেন তারা পাঠকের আগ্রহের চিন্তা করে ক’জন লিখছেন?

হ্যাঁ, একটা সময় ছিল মানুষ প্রচুর উপন্যাস পড়তো। মানুষের তখন হয়তো প্রচুর সময় ছিল। উপন্যাস পড়ে আর পরিবার, বন্ধুবান্ধব মিলে সিনেমা হলে সিনেমা দেখে বিনোদন খুঁজে পেত। কিন্তু ইন্টারনেটের এই যুগে হাতের কাছে এত পড়ার আইটেম, সময় কিল করার জন্য এত সোশ্যাল মিডিয়া; ইউটিউব, স্যাটেলাইট টিভি, অনলাইনে বিনোদনের এত এত কনটেন্ট থাকার পর উপন্যাস পড়ার সময় কোথায়! এমন কি হুমামূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের স্বর্ণযুগেও কি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী সাইজ উপন্যাস লোকে নিয়েছে? নেয়নি। নিবেও না। পাঠকের রুচি এবং চাহিদা দিন দিন বদল হচ্ছে।

যে শিশু-কিশোর সাইন্স ফিকশন, সংক্ষেপে সাই ফাই মুভি দেখে বড় হচ্ছে প্রতিদিন, তাকে কি আর রাক্ষস খোক্ষসের গল্প বা রূপকথার রাজারানী দিয়ে বুঝ দেওয়া যাবে! কতক্ষণ যাবে। বইপাঠে ছোটরা আর ছোট নেই। গল্প-উপন্যাসেও আগ্রহী হচ্ছে না তারা। প্রথমত কে পড়বে এতক্ষণ, দ্বিতীয়ত তারাও বুঝে গল্প-উপন্যাসে বাস্তবতা নেই, বানানো জিনিস। আবার গল্পও এমন দুর্বল, তাদের টেনে নিতে পারছে না। আগেই বলেছি, বড়রাও উপন্যাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাজারে আসলে চাহিদা বাড়ছে ইতিহাস, গবেষণাধর্মী বইয়ের। সত্যাশ্রয়ী বইপত্র। জীবনযুদ্ধের প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে এসব বইয়ের চাহিদা থাকলেও লেখক নেই। বেশিরভাগই লিখছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস।

এদিকে, বইয়ের বাজারটা সম্প্রসারণেও আমাদের কোনও উদ্যোগ নেই। বই এখন আর ঢাকা কেন্দ্রিক মৌসুমী বিষয় নয়। ঢাকার তরুণ-তরুণী, সাহেবরা যা পড়েন, মফস্বল শহরের কোনও বাসিন্দারও একই সময়ে তা পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। রকমারিডটকমসহ অনেক অনলাইন বইয়ের দোকান চালু হয়েছে, যেখানে সহজে পাঠক ঘরে বসে, গ্রামে বসে বই কিনতে পারে। উদ্যোগের যে বিষয়টা উল্লেখ করছি সেটা হচ্ছে বিদেশের বাজারেও এই বই পাঠানো। প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর সঙ্গে বইয়ের ছাপা এবং বাঁধাইকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া।

ঢাকার পাশেই কলকাতা, আগরতলা। কোটি কোটি বাঙলাভাষী মানুষ। অথচ আমরা বাংলা ভাষার বই, বাংলাদেশী বইয়ের বাজার সৃষ্টির কোনও উদ্যোগ দেখি না। আমরা শুধু ভারত সরকারকে দায়ী করে গেলাম যে তারা আমাদের কিছু তাদের বাজারে ঢুকতে দেয় না, যেখানে আমরা আমাদের বইয়ের বাজার, আমাদের আকাশ তাদের জন্য খুলে রেখেছি। কিন্তু সে বাজার খোলা হলেও আমরা বইয়ের মতো একটি পণ্য নিয়ে যেতে পারছি না। আমি তো জানি আমাদের বই পড়ার জন্য, আমাদের টিভি সিনেমা দেখার জন্য কলকাতা-আগরতলা উন্মুখ হয়ে আছে। আজ থেকে ২৮ বছর আগেও কলকাতায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বইয়ের চাহিদা আর প্রশংসা নিজ কানে শুনে এসেছি।

গত নভেম্বরে কলকাতায় যে বাংলাদেশ বইমেলা হলো, কিংবা এই ফেব্রুয়ারির শুরুতে কলকাতায় যে বইমেলা হলো তাতে তো জানি, কলকাতার পাঠকরা প্রবল আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের বই পড়তে চেয়েছে। তারা ইতিহাস, গবেষণার বই খুঁজেছে। আমরা ক’টা দিতে পেরেছি! আমি সরকারের কাছে প্রস্তাব করবো ভারতে বই রফতানির ক্ষেত্রে ইনসেনটিভ চালু করার জন্য। তখন দেখা যাবে কি হারে বই যায় কলকাতা, আগরতলার বাজারে। সবকিছুর জন্য উদ্দীপনা লাগে। উদ্দীপনা পুঁজির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

গবেষণা আর ইতিহাসের বইয়ের যখন চাহিদার কথা বলছি, তখন এবারের বইমেলায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আমার পড়া ইতিহাস নির্ভর একটি বইয়ের কথা না বলে পারছি না। ‘বেজে ওঠে সাইরেন’ নামের এই বইয়ের লেখক লায়লা আফরোজ সংস্কৃতি অঙ্গনে, বিশেষ করে আবৃত্তির জগতের একজন খ্যাতনামা তারকা হলেও বইয়ের জগতের নবীনতম সদস্য। কিন্তু বইটি পড়ে কেউ ভাবতেই পারবে না লেখকের এটি প্রথম বই।

বই কিনে এনে কিংবা উপহার পেয়ে দুই চার পাতা পড়ার পর কত বই যে টেবিলে পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে পুরনো পত্রিকার স্তূপে ফেলে দেই ঠিক নেই। কিন্তু লায়লা আফরোজের ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি গভীর রাতে পড়তে বসেও শেষ না করে উঠা কঠিন ছিল। বইটির সময়কাল ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সাল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ঘটনাবহুল সময় নিয়ে। অন্যদিকে লেখকের জীবনের ৫ বছর থেকে ১৫ বছরের সময়কাল। এই ১০ বছরের মাঝখানে ’৬৫ আর ’৭১ সালের দুটি যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড। আর পুরো বইজুড়ে নায়কের আসনে আছেন একজন সাংবাদিক। তিনি হচ্ছেন প্রয়াত সাংবাদিক এটিএম শামসুদ্দীন, যুদ্ধপূর্ব দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে সোভিয়েট ইউনিয়নের ঢাকাস্থ তথ্য কেন্দ্রের প্রধান বাঙালি কর্মকর্তা এবং উদয়ন পত্রিকার সম্পাদক।

এটিএম শামসুদ্দীন ২০০৯ সালের ৯ জুন অবসরে থাকাকালে মৃত্যুবরণ করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কমরেড মনি সিংহ, শহীদুল্লাহ কায়সার, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। এটিএম শামসুদ্দীন বইটির লেখক লায়লা আফরোজের পিতৃতুল্য বড় ভাই। নিজের জীবনটাই যিনি উৎসর্গ করেছেন পরিবার, সমাজ আর দেশের জন্য।

লায়লা আফরোজ ‘৬৫ সালে তার বাবার মৃত্যুদিনের ঘটনা দিয়েই তার লেখা শুরু করেছেন, শেষ করেছেন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিয়ে। বাড়তি হিসেবে বইতে আছে ভাই এটিএম শামসুদ্দীনের প্রতি বোনের নিবেদিত সংক্ষিপ্ত দুটি অধ্যায়। বাবার মৃত্যুর পর ছোট চার বোন-ভাইকে নিয়ে কীভাবে দুটি যুদ্ধ, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ৯ মাস আর পুরো জীবনযুদ্ধ পার করেছেন তারা, লায়লা আফরোজ এক অসাধারণ প্রকাশভঙ্গিতে তুলে এনেছেন সেই চিত্র। একজন কিশোরীর স্মৃতিতে ওঠে আসা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর চিত্র যেন পুরো বাংলাদেশের চিত্র। প্রতিটি ঘরেই ঘটে গেছে এমন হাজারো ঘটনা, সে সময়ের প্রতিটি মানুষের স্মৃতিতে অমর হয়ে আছে এমন লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিগত কাহিনী।

একদিকে নিজেদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার আকুতি, অবরুদ্ধ ঢাকার চিত্র, প্রাণভয়ে গ্রামে পালানোর ঘটনা- মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিয়ে যায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলো’। তবে পরিণত লেখক, একজন শহীদের মায়ের ইতিহাস নির্ভর দিনপঞ্জির সঙ্গে ‘বেজে ওঠে সাইরেন’-এর কোনও মিল নেই। এটি এক কিশোরীর যুদ্ধদিনের গল্প। এখানে ইতিহাসের চেয়ে বেশি উঠে এসেছে ব্যক্তিজীবন, কালের চিত্র। ইতিহাস এখানে এসেছে প্রসঙ্গকে ধরে, প্রসঙ্গকে ছাপিয়ে ইতিহাস বইতে স্থান নেয়নি।

লায়লা আফরোজের ভাষাশৈলীর দক্ষতা, কাব্যিক বর্ণনা আর অসংখ্য রেফারেন্স- লেখক হিসেবে তাকে যেমন পরিপক্বতার প্রমাণ দেয়, তেমনি আমাদের এটাও শেখায় যে, হাতে কলম-টাকা থাকলেই বই প্রকাশ করে ফেলতে হবে- দরকার নেই। চিন্তা করতে হবে পাঠককে কি উপহার দিচ্ছেন আপনি। কোন্ গরজে পাঠক আপনার বই পড়বে! মনে রাখার মতো, আন্ডার লাইন করার মতো কী আছে আপনার বইতে।

‘বেজে ওঠে সাইরেন’-এর মতো এমন একটি বই উপহার দেওয়ার জন্য আমি বাংলা একোডেমিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এবং অনুরোধ করি এমন নানা বৈচিত্র্যের বই প্রকাশ করে তারা যেন পাঠককে বই কেনায় আগ্রহী করে তুলেন। দেশের বাইরে বাংলা বইয়ের বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখেন। আর পাঠকরা যাতে ভাবতে না পারে বইমেলার নামে হাজার হাজার ‘আবর্জনা’ প্রকাশ করে লেখকরা গাছ ধ্বংস করছে না, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে না।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]। বাংলাট্রিবিউন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়