ডেস্ক রিপোর্ট : খুলনার পাইকগাছার অনির্বাণ পাঠাগার। প্রতিষ্ঠার পর পেরিয়ে গেছে ২৫ বছরেরও বেশি সময়। এখনও নতুন নতুন বই সংগ্রহ করে চলছে। গতকাল শনিবার সকালে কথা হলো এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য নিখিল ভদ্রের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিবছরই অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে পাঠাগারটির জন্য বই কেনেন। এ ছাড়াও অনেক সুহৃদ গ্রন্থমেলা থেকে বই কিনে পাঠাগারে উপহার দেন। শুধু অনির্বাণ পাঠাগার নয়, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিনই মেলায় আসছেন বিভিন্ন পাঠাগারের প্রতিনিধিরা। তারা বই সংগ্রহ করছেন। এ কারণে প্রকাশকরাও দারুণ খুশি। অনেকেই বই বিক্রিতে বাড়িয়ে দিচ্ছেন ছাড়, এমনকি পরবর্তী পাঠাগারের জন্য অনুদান হিসেবে বিনামূল্যে বই দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন।
২২ ফেব্রুয়ারি কথা হয়েছিল মানিকগঞ্জের সিংগাইরের সিকদার আবু বকরের সঙ্গে। নিজের এলাকায় তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে 'গণপাঠাগার' নামে একটি পাঠাগার দিয়েছেন। সেটির জন্য দুই হাত ভরে বই কিনেছেন। বললেন, মেলায় সব প্রকাশককে একসঙ্গে পাওয়া যায়, ফলে দেখে-শুনে বই কেনা যায়। একই সঙ্গে অনেক প্রকাশকই বই কেনার ক্ষেত্রে ছাড়ও বাড়িয়ে দেন।
শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, ব্যক্তিগত পাঠাগারও সমৃদ্ধ করতে অনেকেই মেলার আশ্রয় নেন। এই যেমন নারায়ণগঞ্জের আবদুল্লাহ রায়হান। বললেন, প্রতিবছরই মেলা থেকে প্রচুর বই কিনি। সেগুলোকে এক করে বাড়িতে একটি কক্ষে পাঠাগার তৈরি করে ফেলেছি। সেইসঙ্গে আমরা একান্নবর্তী পরিবার হওয়ায় বইয়ের সংগ্রহও নেহাত কম নয়। আশপাশের অনেকেই আমাদের এ পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়েন।
এ বিষয়ে প্রচার বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বিভিন্ন পাঠাগারকে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়। যাতে তারা মেলা থেকে পাঠাগারের জন্য বই কিনতে পারে। আমাদের এখানেও এমন সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত।
তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে অনিন্দ্য প্রকাশের স্বত্বাধিকারী আফজাল হোসেন বলেন, বইমেলায় অনেক পাঠাগারই বই সংগ্রহ করে, তবে তারা বেশি ক্যাটালগ সংগ্রহ করে, যাতে পরে বই কিনতে পারে। তার মতে, পাঠাগারের জন্য যারা বই কেনেন, তাদের জন্য বই কেনার ক্ষেত্রে ছাড় বৃদ্ধি করা উচিত। এর ফলে পাঠকশ্রেণি গড়ে উঠবে বলেও তিনি মনে করেন।
ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আদিত্য অন্তর বলেন, বেশিরভাগ পাঠাগারই এই মেলা থেকে বই কেনে। আমরাও চেষ্টা করি, তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার। পাঠাগারগুলো শক্তিশালী হলে পাঠক গড়ে উঠবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সহযোগিতা করি।
টাস্কফোর্সের অভিযানে এক বই জব্দ : মেলার বাকি ছিল আর চারদিন। অবশেষে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় অভিযানে নামে মেলার টাস্কফোর্স। নেমেই একটি বই জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে লিফলেট বিতরণের দায়ে একটি প্রকাশনীকে মৌখিকভাবে সতর্ক করেছে টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব ড. তপন বাগচীর নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য থাকায় আলীগড় লাইব্রেরি থেকে মশিউর রহমান তৌহিদের 'দ্য বেঙ্গল কেমিস্ট্রি' বইটি জব্দ করা হয়। তবে বইটির প্রিন্টার্স লাইনে প্রকাশনী হিসেবে প্রেসিডেন্সি পাবলিকেশন্স ঢাকা উল্লেখ করা হয়েছে। বইটি ২০১৬ সালের মার্চ মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। দ্বিতীয় প্রকাশ হয়েছে তার পরের মাসেই। ২০১৬ সালের নভেম্বরে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হয় বলে বইটির প্রিন্টার্স লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও লিফলেট ও বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য দোয়েল প্রকাশনীকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়।
মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, আজ রোববার টাস্কফোর্সের বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে গতকাল বিকেলে মেলা প্রাঙ্গণে এসেছিলেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন। তিনি অবসরের প্যাভিলিয়নে বসেন। এ সময় তিনি অবসর থেকে প্রকাশিত শোয়েব সর্বনামের 'শাওনের বয়ানে হুমায়ূন' বইটির ওপর ভক্তদের অটোগ্রাফ দেন।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ঘোষণা : অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি পরিচালিত চারটি গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রথমা প্রকাশনকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০১৮; ২০১৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য অলকনন্দা প্যাটেলের 'পৃথিবীর পথে হেঁটে' গ্রন্থের জন্য বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, সুফি মুস্তাফিজুর রহমানের 'বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার' গ্রন্থের জন্য জার্নিম্যান বুক্স এবং মঈন আহমেদ সম্পাদিত 'মিনি বিশ্বকোষ পাখি' গ্রন্থের জন্য সময় প্রকাশনকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৮; ২০১৭ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য চন্দ্রাবতী একাডেমিকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০১৮ এবং ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কথাপ্রকাশকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৮ দেওয়া হয়। আগামী বুধবার গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব পুরস্কার পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
'পাঠাও'র বই 'অগ্রযাত্রার অগ্রদূত' : রাইড শেয়ারিং অ্যাপস হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে পাঠাও। পাঠাওয়ের এই পথচলায় প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে দারুণ সব বাস্তব গল্প। সেগুলোর মধ্যে কিছু গল্প নিয়ে মেলায় প্রকাশিত হয়েছে বই 'অগ্রযাত্রার অগ্রদূত'। সাহস পাবলিকেশন্সে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
নতুন বই : বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মেলার ২৪তম দিনে ১৮২টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে গল্প ৩৬, উপন্যাস ১৮, প্রবন্ধ ১৩, কবিতা ৫৪, গবেষণা ১১, ছড়া ৪, শিশুসাহিত্য ৫, জীবনী ২, মুক্তিযুদ্ধ ২, নাটক ২, বিজ্ঞান ৩, ভ্রমণ ৩, ইতিহাস ৫, স্বাস্থ্য ১, অনুবাদ ৩২, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ২ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর ১৮টি নতুন বই এসেছে।
এর মধ্যে রয়েছে হাসনাত আবদুল হাইয়ের টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি এবং অন্যান্য (আগামী); রকিব হাসানের ইউএফও রহস্য (পুথিনিলয়); মনি হায়দারের জিহ্বার মিছিল (মাওলা ব্রাদার্স); জি এম ফয়সাল আলমের 'টেলিভিশনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা' (ভাষাচিত্র); হাসান জাভেদের 'রোহিঙ্গার উপাখ্যান :নাফ নদীর তীরে কন্যা' (দেশ পাবলিকেশন্স); আন্দালিব রাশদির 'কঙ্কাবতীর নাইন্থ ফ্লোর' (কথাপ্রকাশ); জয়া ফারহানার 'পড়ানের পোড়া পুরাণ' (বেহুলা বাংলা); আমীরুল ইসলামের 'আমার বাবার গল্প' ও দন্তস্য রওশনের 'ভূতম্যান' (পাঞ্জেরী), আসাদ চৌধুরীর 'জাপানি হাইকু' (আবিস্কার); আহমদ রফিকের 'ভাষা আন্দোলন :ইতিহাসের রূপরেখা' (গৌরব প্রকাশন) এবং সাইফুর রহমানের 'পক্ষিরাজের ডানা' (ঐতিহ্য)।
মূলমঞ্চের আয়োজন : গতকাল গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ছিল 'দেশ বিভাগের সত্তর বছর' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইমানুল হক। আলোচনায় অংশ নেন সৈয়দ হাসান ইমাম। সভাপতিত্ব করেন কামাল লোহানী। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল ইমন চৌধুরীর পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ফাল্কগ্দুনী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থার পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন তাপসী ঘোষ, মুন্নী কাদের, ফারহানা শিরিন, মোক্তার হোসেন ও এম এম উম্মে রুমা ট্রকি।
আজকের অনুষ্ঠান : আজ রোববার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৫তম দিনে মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে রয়েছে 'ভাষাসংগ্রামী নাদিরা বেগম ও ভাষাসংগ্রামী মমতাজ বেগম' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রামেন্দু মজুমদার ও রফিউর রাব্বি। আলোচনায় অংশ নেবেন শফি আহমদ এবং মালেকা বেগম। সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তথ্যসূত্র : সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :