শিরোনাম
◈ আবদুল্লাহ জাহাজে খাবার থাকলেও সংকট বিশুদ্ধ পানির ◈ কিছুটা কমেছে পেঁয়াজ ও সবজির দাম, বেড়েছে আলুর ◈ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় কোনো ভাষা জানেন না, সময় এসেছে তৃতীয় ভাষার ◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র

প্রকাশিত : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০১:৫১ রাত
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০১:৫১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নির্যাতন: দায় ও দায়িত্ব

 মো. জিল্লুর রহমান : বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে নানাভাবে ছাত্র-ছাত্রী নির্যাতন একটি ভয়াভহ ব্যাধী হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে। নানাভাবে এটি অতি দ্রুতবেগে সংক্রমিত হচ্ছে। কমবেশি প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গোচরে অগোচরে এধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কখনো নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের উপর Rag এর নামে দাদাগিরি করা কখনো বা রাজনৈতিক আন্তঃ বা অন্তঃ কোন্দল আবার কখনো প্রশাসনের লেজুড়বৃত্তির কারনে সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কোন না কোনভাবে আমাদের ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক রুপ প্রধান অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে সমাজের সামগ্রিকভাবে ক্ষয়ে যাওয়া মুল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং যেনতেনভাবে সবকিছু পাওয়ার অস্থির প্রতিযোগিতা সমভাবে দায়ী।

সর্বোপরী শিক্ষক সমাজের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারনে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার সৎ সাহসের অভাব ও দায়িত্বহীনতা কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না বা নিয়ন্ত্রন করা দরকার কি-না সে আলোচনা অবান্তর কারন বিষয়টি সরাসরি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। একই কারনে বিবদমান ছাত্র সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ বা সংঘাত সেটিও এখানে আলোচনা নিস্প্রয়োজন। কারন বর্তমান সময়ে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতির একতরফা অবস্থান চলছে এটা স্পষ্ট। কিন্তু ক্যাম্পাস বা হলসমূহে সাধারন ছাত্র-ছাত্রীর উপর রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কারনে যে অপ্রত্যাশিত নির্যাতন নিয়মে পরিণত হয়েছে সেটা রুখতে না পারলে একমসয় হয়তো এটি স্থায়ী ব্যাধীতে পরিনত হবে।

রাজনেতিক ছত্রছায়ায় বা সমষ্টিগতভাবে নিজেদের সিনিয়রিটি প্রদর্শনের জন্য, সে যে কারনেই হোক না কেন এই চর্চা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে নিসন্দেহে এটি আরো ভয়াভহরুপ ধারন করবে। ব্যাক্তি কেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ বা নির্যাতন সাধারনত দুই ভাবে সংগঠিত হয়। প্রথমত: Rag এর নামে এবং দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক অন্তঃদ্বন্দের জেরে কাউকে কাউকে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের মিথ্যা সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সাধারনত শিক্ষা সমাপনি হৈহুল্লোড়কে Rag ডে হিসেবে পালন করে থাকে। কিন্তু এটি কখনোই কোথাও কাউকে ভয়ভীতি বা দৈহিকভাবে প্রহার বা লাঞ্চিত করার মত কাজ হিসেবে পালন করা হয় না। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে নতুন ছাত্র ভর্তির পর তাদের পূর্বসূরী কর্তৃক (সিনিয়র ছাত্র) রাতের অন্ধকারে হলসমূহে বিশেষ অভ্যর্থনা বা রিসিপশনকে র‌্যাগ হিসেবে প্রচলন করা হয়েছে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর প্রচলন কখন কিভাবে বিস্তার লাভ করেছে তার কোন সুনির্দিষ্ট সময়কাল না থাকলেও এটি গত কয়েক দশকে বিশেষ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সংক্রামক ব্যাধীর ন্যায় একটি ভীতিকর আপোদ হিসেবে আর্বিভ’ত হয়েছে। প্রতি বছরই অপ্রকাশিত অনেক ঘটনার মধ্য থেকে দু-একটি ঘটনা কোন না কোন ছাত্রের শারীরিক ও মানোষিক বিকলাঙ্গ হওয়ার ঘটনা এমনকি জীবননাশের কারনও হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি মাত্রায় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সীমিত আকারে হলেও এর প্রচলন চলমান। এবছরে আমি ব্যাক্তিগতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি আমার এক আত্নীয়কে ভর্তি করার মাধ্যমে। সে এবছরে একাধারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য একটি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায় এবং আমার কাছে কোথায় ভর্তি হবে মর্মে তার বাবা মা পরামর্শ চায়।

স্বাভাবিকভাবেই আমি কোন ভাবনা চিন্তা ব্যাতিরেকে ঢাবিতে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছি এবং সে মোতাবেক ভর্তিও হয়েছে। ক্লাস শুরুর ১০ থেকে ১৫ দিন পর আমার বাসায় এসে সে বলে ঢাবিতে নাকি সে পড়বে না এবং আগামী বছর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবার প্রস্তুতি নিবে। কারণ জানতে চাইলে ছেলেটি যে বর্ণনা দিলো তা সত্যিই মফস্বল থেকে সদ্য ঢাকাতে আসা যে কোন ছেলে বা মেয়ের জন্য অসহনীয়ই নয় রীতিমত ভীতিকর। রাত ৩ টার আগে হলে প্রবেশ নিষিদ্ধ, হল ডাইনিং এ খাবার খাওয়া যাবে না, সিগারেটে অভ্যস্ত কি না না হলে জোর পূর্বক সিগারেট খাওয়ানো এর বাইরে নানা ছুতোই চড় থাপ্পড় মামুলি ব্যাপার। কযেকদিন পরপর প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া প্রতিটি ছাত্রকে হলের Interogation Cell এ হাজিরা দেয়া, যার নাম ”গেষ্টরুম”।

মফস্বলের যে ছেলেটি ইতিপূর্বে তার মায়ের কোলের বাইরে যায় নি তাকে হঠাৎ করে এধরনের ঘটনা মোকাবিলা করা শারিরিক ও মনোজতাত্বিকভাবে কতটা দূর্বিসহ তা কেবলমাত্র ভুক্তভূগিই বলতে পারে। সময়ের ব্যবধানে হয়ত সব মানিয়ে নেয়া যায় কিন্ত কারো কারো যে অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে যায় তার দায় কি এড়িয়ে যাওয়ার মত? যেমনটি ঘটেছে জাহাঙ্গীরনগরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের এক ছাত্রকে মানসিক নির্যাতন করেছেন ওই বিভাগের ৪৬ তম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থী মো. মিজানুর রাহমান কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষে সদ্য ভর্তি হয়েছেন। মিজানুরের সহপাঠিরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বিভাগের ৪৬ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তাঁদের (৪৭ তম ব্যাচ) সঙ্গে পরিচিত হওয়ার নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন (সমকাল, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)। মানসিকভাবে ছেলেটি এতটাই বিপর্যস্তু হয়েছেন যে তিনি তাঁর পিতাকে দেখে চিনতে পারেন নি।

একই প্রতিষ্ঠানের একই হল বা বিভাগে ভর্তি হওয়া তাদেরই অনুজদের সাথে এ জাতীয় বন্য বা জংলি ব্যবহারের বেধতা তারা পেল কোথা থেকে? কারাই-বা তাঁদের এই ধরনের নির্যাতন করার স্বীকৃতি দিল? এব্যাপারে সঠিক সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিলে অবশ্যই এটি নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। একসময় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নষ্ট সংস্কৃতি প্রকট আকার ধারন করেছিলো যা প্রায় নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গিয়েছিল। সে অবস্থায় প্রশাসনের অত্যন্ত সুদৃঢ় পদক্ষেপের কারণে এমনকি কিছু ছাত্রের বহিঃস্কারের মত কঠিন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেখানে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক অন্তঃকোন্দল বা ব্যাক্তি আক্রোশের কারনে প্রতিশোধের অস্ত্র হিসেবে ভূক্তভোগী ছাত্র বা ছাত্রীকে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের লেবেল দিয়ে তার উপর অকথ্য নির্যাতন করা। যেমনটি ঘটেছে ঢাবির এহসান রফিকের ক্ষেত্রে। ঘটনার বিবরনে না গিয়ে এহসানের বাবা এবং বাবার বন্ধু বান্ধব আত্নীয়-স্বজনদের যে ক্ষোভ বা কষ্ট তার দায় কে নিবে? ক্ষোভ বা কষ্ট কতটা প্রকট তার প্রমান জনৈক আসিফ কাজল নামক এক ব্যাক্তির ফেসবুক পেজের অভিব্যাক্তির কিছু অংশ হুবহু তুলে ধরলাম:

ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু !

ছোটবেলা থেকেই দেখছি এহসান রফিককে। কোলে পিটে করে মানুষ করা ছেলেটি সাংঘাতিক মেধাবী। ওর আব্বা রফিকুল ইসলাম মন্টু আমার বাল্য বন্ধু। কলেজে অধ্যাপনা করার পাশাপাশি বৈশাখী টিভি ও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ করেন। কষ্ট করে দুটি সন্তানকে মানুষ করছেন। তারা কোন দলের লেজুড়বৃত্তি করেন না। দুটি ছেলেও কোন দলের সাথে যুক্ত নয়। বড় ছেলে এহসান রফিক মেধার গুনে ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য আর্মি মেডিকেলেও সে চান্স পেয়েছিলো। ছবির এই চেহারাটি কি বিভৎস্য ! সত্য হলেও ছবিটি এহসান রফিকের। কত নির্মল আর সুস্থ ছেলেটি বাবা পাঠিয়েছিলো ঢাবিতে পড়তে। ছেলে বড় হয়ে দেশ সেবা করবে। মানুষ হবে। অন্তত বৃদ্ধকালে বাবা মাকে দেখবে। কিন্তু হায়রে নিয়তি। মানুষ হয়ে মানুষকে এ ভাবে কেও নির্যাতন করেত পারে ? হায়রে ছাত্র রাজনীতি !! বড় আফসোস! আজ তোমাদের এই হাল দেখে চরম ঘৃনা হয়, ক্ষোভ জন্মে নিজেকে বিলিয়ে দিই কোন ঘাতকের পদতলে।”

দু:খজনক হলেও সত্য বছরের পর বছর হলগুলোতে হরর মুভির ন্যায় এধরনের অমানবিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। কোথায় এর শেষ এবং শেষ করার দায়িত্বই বা কার? ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন সামনে আসে বারবার। একদিনে এ পরিবেশ তৈরি হয়নি তেমনি একদিনে শেষ হবে তা ভাবাও অবান্তর। কিন্তু মানুষ তৈরির আঙ্গিনায় এধরনের অমানবিক আচরন কি চলতেই থাকবে? নির্যাতনের মাত্রা এবং নির্যাতিতের মিছিল আর কত বড় হলে আমরা একে সমস্যা বলব এবং তা সমাধানের চেষ্টা করব?

বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও ব্যাক্তি স্বার্থের কালো চশমার আড়ালে আর কতকাল মুখ লুকাবো? নিজের স্বকীয়তাকে আর কত বিসর্জন দিয়ে বলব আমি সম্মানিতদের একজন? আসুন আমরা সত্যিকার অর্থে এর সকল দায় কাধে নিয়ে নিজেদের অর্জিত সঠিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মানবিক গুনে বদলে দেয়ার চেষ্টা করি আগামীর সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে। যেমনটি প্রখ্যাত দার্শনিক Jean Jacques Rousseau বলেছেন "We are born weak, we need of help; we are born destitute... we have need of assistance; we are born stupid, we have need of understanding."
In other words, human beings need outside intervention to develop their natural propensity for good.

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়