শিরোনাম
◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে ◈ সেনা গোয়েন্দাসংস্থার বিরুদ্ধে ৬ পাক বিচারপতির ভয় দেখানোর অভিযোগ ◈ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা সাদা পতাকা উড়াচ্ছিল, তাদের বূলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দিল ইসরায়েলী সেনারা

প্রকাশিত : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৯:১৪ সকাল
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৯:১৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

খুদে থেকে দুঁদে

ডেস্ক রিপোর্ট : ১১০ বছর আগে গঠিত হয় ইডিকা। জার্মানির খুদে ব্যবসায়ীদের সমবায়। বড় কোম্পানির প্রতাপ, সরকারি বিধিনিষেধ, দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় সংগঠনটি। বৈরিতা পেরিয়ে ইডিকা হয়ে উঠেছে দুঁদে রিটেইলার।

জার্মানির গ্রোসারি বাজারে স্থানীয় কোম্পানিগুলোরই আধিপত্য। বিশেষত হাইপারমার্কেট, সুপারমার্কেট ও ডিসকাউন্টারদের ক্ষেত্রে কথাটি বেশি সত্য। এক দশক আগে জার্মানদের আধিপত্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় ওয়ালমার্ট। একই উদ্দেশ্যে লেগে থাকলেও এখনো পায়ের নিচে শক্ত মাটি পায়নি ডাচ জায়ান্ট রয়্যাল আহোল্ট (বর্তমানে আহোল্ট-দেলেইজে)। জার্মানির রিটেইল মানচিত্রে আয়তন হ্রাস-বৃদ্ধি হয় স্থানীয়দের মধ্যেই। পণ্যমূল্য, আউটলেট নেটওয়ার্ক ও ক্রেতা সন্তুষ্টি নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অতিকায় জার্মান চেইনগুলো।

মূল্য ও মানের প্রশ্নে খুঁতখুঁতে জার্মানদের ঘিরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আধিপত্য করছে ইডিকা। বাজার দখলের লড়াইয়ে ইডিকার ভূখণ্ড ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৬ সালে ৬ হাজার ১২৮ কোটি ডলার বিক্রির পর গত বছর ২৩৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ইডিকা। নতুন আড়াইশ প্রডাক্ট উন্মোচন ও ১৩২টি স্টোর উদ্বোধনের সুবাদে বছর শেষে বাজার-অংশ উন্নীত হয়েছে ২০ শতাংশে। জার্মানির শীর্ষ এ গ্রোসারি রিটেইলার টানা এক দশক ধরে ক্রমেই নিজের বিক্রি ও বাজার-অংশ বাড়িয়ে চলেছে।

ইডিকার মোট স্টোর ১১ হাজার ৪০০। এর মধ্যে ৫ হাজার ৯০০ স্টোর চালান স্বতন্ত্র ব্যবসায়ীরা। নিজস্ব নামে চালিত এ স্টোরগুলো ইডিকার সাইন দেখে চেনা যায়। সমবায়ের সদস্য হিসেবে ইডিকা থেকে পণ্য নিয়ে বিক্রি করে স্বতন্ত্র স্টোরগুলো। এছাড়া চার হাজারের কিছু বেশি স্টোর রয়েছে ইডিকার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে; যেগুলো ইডিকা, নেট্টো ও স্পার ব্র্যান্ড নামে চলে। স্বতন্ত্র ও ব্র্যান্ডেড দুই ধরনের স্টোরেই ক্রেতাদের সমান সুবিধা দেয়া হয়। পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রেও অভিন্ন মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়। স্টোরে এ বৈচিত্র্যের মূল রয়েছে ইডিকার ইতিহাসে।

উনিশ শতকের শেষদিক থেকে বড় ব্যবসায়ীদের দাপটে জার্মানির খুদে দোকানিরা হারিয়ে যাচ্ছিলেন। টিকে থাকার প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছিলেন ব্যাভারিয়া, রাইন, ওয়েস্টফালিয়াসহ বিভিন্ন রাজ্যের মুদি ব্যবসায়ীরা। বিশ শতকের শুরুতে তারা কয়েকটি সমবায় সমিতি গঠন করেন। বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে বেশি পরিমাণে পণ্য কেনার সামর্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এসব সমবায়কে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন ফ্রিটজ বোরমান ও কার্ল বিলার। মাত্র ৮০০ মার্ক পুঁজি নিয়ে ১৯০৭ সালে তারা গঠন করেন অ্যাসোসিয়েশন অব জার্মান রিটেইল কো-অপারেটিভস। কিছুদিনের মধ্যে আরো কয়েকটি সমবায় সমিতি অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেয়। ১৯০৮ সালের মে মাসের একদিন ২৩টি সমবায়ের ৮০ জন প্রতিনিধি একত্র হন। বার্লিনের ওই সভায় তারা গঠন করেন সেন্ট্রাল পারচেজিং কো-অপারেটিভ অব দি অ্যাসোসিয়েশন অব জার্মান রিটেইল কো-অপারেটিভস; জার্মান ভাষায় যার নাম হয় ইডিকা।

প্রতিষ্ঠার পর পরই ইডিকা সাফল্য দেখতে পায়। ১৯১০ সালে সংগঠনটি নিজস্ব বিজ্ঞাপন বিভাগ গঠন করে। নিজস্ব কোনো ব্র্যান্ড না থাকায় পরের বছর কয়েকটি নামি ব্র্যান্ড কিনে নেয় ইডিকা। সদস্যদের ঋণ দেয়ার সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইডিকা কো-অপারেটিভ ব্যাংক। খুদে দোকানিদের সংঘবদ্ধতা ও শক্তি দেখে জার্মানির বড় রিটেইলাররা ক্ষুব্ধ হন। ইডিকার কাছে ডিসকাউন্টে পণ্য বিক্রি না করতে তারা সরবরাহকারকদের চাপ দেন। চাপের মুখে ইডিকাকে বয়কট করতে বাধ্য হয় ৪৪টি কোম্পানি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অব্যবহিত আগে জার্মান অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা চলছিল। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার বাণিজ্য ও পণ্যপ্রবাহে বিধিনিষেধ আরোপ করে। প্রয়োজন মনে হলে যেকোনো গুদামের পণ্য জব্দ করার এখতিয়ার দেয়া হয় সিটি ও কাউন্টি প্রশাসকদের। আতঙ্কগ্রস্ত জার্মানরা দোকানে গিয়ে যা পাচ্ছিল, তা-ই কিনে মজুদ করছিল। সমবায় হিসেবে বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামোর সুবাদে ইডিকা শক্ত হাতে এ সংকট মোকাবেলা ও পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সমর্থ হয়। এর ফলে ভোক্তাদের মনেও ইডিকা সম্পর্কে আস্থা সৃষ্টি হয়। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর পণ্যবাজারে স্বস্তি ও স্থিতি রাখতে স্থানীয় সরকারগুলো ইডিকার সহায়তা চায়। কয়েক বছরে অনেকগুলো নতুন ইডিকা শপ চালু হয়। অবশেষে ১৯১৮ সালে ইডিকা সমবায় হিসেবে সনদ পায়। আইনি স্বীকৃতির সুবাদে প্রতিষ্ঠানটি বণিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। নিজ নামে বেশি পণ্য কেনা ও মূল্য ছাড় পাওয়ার অধিকার অর্জন করে ইডিকা।

যুদ্ধ শেষে কঠিন মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে জার্মানি। তত দিনে ইডিকার সদস্য সংখ্যা ৫৭৮। কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি দৃঢ় করতে ইডিকা ২০ মার্ক মূল্যমানের সঞ্চয়ী কুপন ইস্যু করে। প্রত্যেক সদস্যকে সপ্তাহে অন্তত একটি কুপন কেনার অনুরোধ জানিয়ে ইডিকা ৬ শতাংশ সুদের প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯২৩ সালে অফিস ও গুদামের জন্য প্রত্যেক সদস্যের কাছে ২০ মার্ক চাঁদা চায় ইডিকা। বল্গাহীন মূল্যস্ফীতির হ্রাস টানতে ইডিকা চালু করে নিজস্ব মুদ্রা, যা সদস্য রিটেইলাররা গ্রহণ করতেন। ১৯২৪ সালে সমবায়ভুক্ত স্টোরে দৃশ্যমানভাবে ইডিকা সাইন সংযোজনের নির্দেশনা দেয়া হয়। সংকটাপন্ন স্টোর সামলাতে ইডিকার পক্ষ থেকে তখন জনবল সহায়তা দেয়া হতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপকরা অনভিজ্ঞ ও পুঁজি সংকটে থাকা খুদে মুদিদের সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্জিত আস্থার সুবাদে ইডিকা ত্রিশের দশকে মহামন্দায় জার্মানদের আস্থার ঠিকানা হয়ে ওঠে।

১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় এসে অ্যাডলফ হিটলার জার্মান অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ইডিকার বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামোর কারণে হিটলার এখানে পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। ১৯৩৪ সালে তিনি বিদেশী পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করলে ইডিকা ইতালি, গ্রিস ও তুরস্কে নতুন শাখা উদ্বোধন করে। একই সঙ্গে ইডিকা ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট নামে একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। হিটলারের আমলে বড় রিটেইলাররা ইডিকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহারে জোর তদবির চালায়। ১৯৩৬-৩৯ সময়কালে সরকারের উপর্যুপরি বিধিনিষেধ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের খড়্গ পড়ে ইডিকার ঘাড়ে। এতে বিরাট লোকসান হলেও ইডিকা শক্ত ভিতের কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি পায়। তত দিনে পণ্য সংখ্যাও ৪০০ ছাড়ায়। ১৯৪৩ সালে মিত্রবাহিনীর বোমায় বার্লিনে ইডিকার প্রধান কার্যালয় বিধ্বস্ত ও আগুনে পুড়ে যায়। কিন্তু ইডিকার চলিঞ্চুতা তাতে ক্ষুণ্ন হয়নি। হাজার হাজার জার্মান কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলেও ইডিকা কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানি দুভাগ হলে ইডিকা বার্লিন থেকে হামবুর্গে কার্যালয় স্থানান্তর করে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ জার্মানির ২০ শতাংশের বেশি রিটেইলার ইডিকার সঙ্গে যোগ হয়। ১৯৫৫ সালে হিমায়িত খাদ্য ও ফল বিক্রি শুরু করে ইডিকা। এ চেইনের মাধ্যমেই জার্মানিতে সেলফ সার্ভিস শপিং প্রবর্তন হয়। ১৯৫৮ সালে ইডিকার স্টোর ছিল ৪০ হাজার। এর মধ্যে সাত হাজার ছিল সেলফ সার্ভিস। ইউরোপিয়ান কমন মার্কেট গঠনের উদ্যোগ শুরু হলে ইডিকা ব্রাসেলসভিত্তিক ইউনিয়ন অব ফুড কো-অপারেটিভসে যোগ দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সমবায় সংগঠনগুলোর স্বার্থ রক্ষায় ইডিকা তখন থেকে সোচ্চার ভূমিকা রাখছে। ১৯৬৩ সালে মাংস বিক্রি শুরু করে ইডিকা। ১৯৬৫ সালে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বিতরণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৮৮ সাল নাগাদ ইডিকার সদস্য সংখ্যা ১১ হাজারে দাঁড়ায়। ১৯৯৯ সালে জার্মানির পঞ্চম বৃহত্তম খাদ্য বিক্রেতা কোম্পানি টেনজেলমান ইডিকা নেটওয়ার্কে যোগ দেয়। এর ফলে টেনজেলমান ও কাউজার ফুড চেইন ইডিকার নিয়ন্ত্রণে আসে।

নব্বইয়ের দশকজুড়ে স্টোর রিমডেলিংয়ের সুবাদে হাইপারমার্কেট, সুপারমার্কেট ও সুপারস্টোর ফরম্যাটে জার্মানির অন্যতম সম্ভ্রমজাগানিয়া রিটেইলার হিসেবে আবির্ভূত হয় ইডিকা। গ্রোসারি ও ফুড রিটেইলিংয়ের পাশাপাশি ওষুধ, পানীয়, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, প্রকাশনা ও ব্যাংকিং— ইডিকায় কর্মরত রয়েছে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ। সূত্র : বণিক বার্তা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়