শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু, মানতে হবে কিছু নির্দেশনা ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা

প্রকাশিত : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:২১ দুপুর
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:২১ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

চালের দাম কত হওয়া উচিত?

ড. আর এম দেবনাথ : চালের দাম কত হওয়া উচিত—এ ব্যাপারে গত সপ্তাহে দু’জন প্রভাবশালী মন্ত্রী তাদের মত প্রকাশ করেছেন। ঘটনাক্রমে দু’জনই বলেছেন চালের দাম কেজিপ্রতি হওয়া উচিত ৪০ টাকা। যে দু’জন মন্ত্রী ৪০ টাকার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন তাদের একজন হচ্ছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং অন্যজন হচ্ছেন মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ। দু’জনই বর্তমান মন্ত্রিসভার সিনিয়র মন্ত্রী এবং প্রচুর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন—একজন রাজনীতিতে, আরেকজন প্রশাসনে এবং অর্থনীতিতে। তারা কেন কেজিপ্রতি ৪০ টাকার কথা বললেন, তা আমার জানা নেই। এটা হতে পারত ৩০ টাকা কেজি, হতে পারত ৫০ টাকা কেজি। তবে দু’জনের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় তারা কৃষকের কথা বিবেচনা করে ৪০ টাকার কথা বলেছেন। তারা মনে করেন ৪০ টাকা কেজি চাল হলে কৃষকের চাল উত্পাদন করা পোষাবে। অবশ্যই এই হিসাবে ক্রেতার দৃষ্টিকোণ বিবেচিত হয়নি। ৪০ টাকা হলে বিক্রেতা হিসেবে কৃষকের পোষাবে, কিন্তু ৪০ টাকা দরে সাধারণ মানুষ চাল কিনে খেতে পারবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর নেই। অথচ হিসাব করতে হবে দুই কূল থেকেই। উভয় কূলই রক্ষা করতে হবে। বস্তুত এটাই এখন একটা বড় সংকট। উন্নতি কোনো সংকট নয়, উন্নয়ন কোনো সংকট নয়।

এমনকী উত্পাদনেও বড় কোনো সংকট নেই। কিন্তু সংকট হচ্ছে চালের দামে। চালের দাম বেশি হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়। বেকার মানুষ, বিধবা, স্বল্প আয়ী, দুঃস্থ, অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী মানুষজন চালের দাম বাড়লে কষ্টে পড়ে। অনেক সময় তাদের একাহারে থাকতে হয়। তারা হয় অতিদরিদ্র। এদেরকে সরকারের ভরণ-পোষণ করতে হয়। শত হোক গণতান্ত্রিক একটা দেশে মানুষ না খেয়ে থাকলে এর পরিণতি ভয়ঙ্কর। গণতান্ত্রিক কেন স্বৈরতান্ত্রিক দেশেও অভুক্ত মানুষ একটা ভয়ঙ্কর সংবাদ। এটা ভয়ঙ্কর বিশ্বের ধনীদের জন্যও। তারা একথা প্রতি বছর ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের’ (ডব্লিওইএফ) সভায় উচ্চকণ্ঠে বলেন। যদিও ঐ সভায় হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকরা বলেন সভায় উপস্থিত শত শত কোটি টাকার মালিকদেরকে। তবু ধরে নিই এর একটা মূল্য আছে। মানুষ বৈষম্য ও দারিদ্র্য সম্পর্কে সচেতন হয়। দারিদ্র্যের অপরপৃষ্ঠে যারা আছেন তারাও কিন্তু কম গুরুত্ব বহন করেন না। এরা হচ্ছে খাদ্য উত্পাদক—ধান-চাল, ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস উত্পাদকগণ। এরা মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখে। তাদের প্রশ্নও সিরিয়াস। তারা তাদের পণ্যের মূল্য পান কিনা এটাও বড় প্রশ্ন, খুবই বড় প্রশ্ন।

একজনকে খাওয়াতে গিয়ে তো আরেকজনকে মারা যাবে না। সাধারণ মানুষকে খাওয়াতে গিয়ে যদি উত্পাদককে মেরে ফেলা হয় তাহলে তা হবে সমূহ বিপদ। সমস্যা তাই কীভাবে ভোক্তা ও উত্পাদককে জীবিত রাখা যায়। বাংলাদেশে এই সমস্যাটা দিনদিন গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। প্রতিবেশী দেশে এই সমস্যা আরো প্রকট। সেখানে ভোক্তারা, বিশেষ করে গরিব মানুষ, প্রান্তিক মানুষ, অতি দরিদ্ররা এক টাকা-দুই টাকা কেজি দরে চাল পায়। ত্রিপুরা রাজ্যে তা দেখে এসেছি। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও তাই। তারা দুই গ্রুপ করেছে গরিবদের। একটা ‘বিপিএল’ (বিলো পোভার্টি লাইন) এবং আরেকটা ‘প্রভাব পোভার্টি লাইন’। অতি সস্তায় এদের রেশনে নিয়মিত চাল-ডাল দেওয়া হয়। এতে গরিব মানুষ বেঁচে গেছে বলা যায়। কিন্তু পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে আরেক মারাত্মক ঘটনা। প্রতিবছর সহস্রাধিক কৃষক নানা ভারতীয় রাজ্যে আত্মহত্যা করে মারা যাচ্ছে। গত তিন বছরে তিন-চার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে মারা গছে। এই আত্মহত্যার অন্যতম কারণ ন্যায্যমূল্য না পাওয়া-পণ্যের মূল্য না পাওয়া। সম্ভবত এই কারণেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ভারতীয় বাজেটে কৃষির ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটা ভিন্নধর্মী বাজেট ঘোষণা করেছেন। ঘটনাক্রমে আমাদের দেশে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হয়ে আত্মহত্যা করে না। কিন্তু কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। প্রতিবছর এই নিয়ে আলোচনা হয়, বিতর্ক হয়। মানুষ ভাবে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় রাজনীতিবিদরা। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। সরকার নিম্নতম ক্রয়মূল্য ঘোষণা করে এবং এই মূল্যে ধান-চাল-গম কিনে নেয়।

সরকার কৃষককে ভর্তুকিতে সার দেয়, সেচের জল দেয়, বিদ্যুত্ দেয়, কীটনাশক দেয়, কৃষি উপকরণ দেয়। উদ্দেশ্য কৃষককে বা উত্পাদককে পুষিয়ে দেওয়া। কিন্তু বলাইবাহুল্য এতেও ন্যায্যমূল্যের বিষয়টি আলোচনার বাইরে যায়নি। বরাবরের মতো এখনো তা তাজা বিষয়। এই কারণেই সম্ভবত বাণিজ্যমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর মতো বর্তমান মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদ্বয় চালের দাম কত হওয়া উচিত এই সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করলেন। উদ্দেশ্য কৃষককে পুষিয়ে দেওয়া, উত্পাদককে পুষিয়ে দেওয়া। আমার মনে হয় বিষয়টি পুষিয়ে দেওয়া নয়। কৃষক লোকসান দিল, আর আমরা তা পুষিয়ে দিলাম-এভাবে ভাবলে আমার মনে হয় ঠিক হবে না। প্রকৃতপক্ষে কৃষিকে কীভাবে লাভজনক করা যায় সেটাই হওয়া উচিত আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এখন পর্যন্ত কৃষি একটি লোকসানি কারবার। কেউ কৃষিতে নিয়োজিত থাকতে চায় না। একটা উদাহরণ দিই।

আমার এক বন্ধু বছর দুই আগে মারা গেছেন। তিনি লেখাপড়া বেশি করেননি। গ্রামেই থাকতেন। তার তিন সন্তান। এক ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। আরেক ছেলে সৌদি আরবে চাকরি করে। মাসে মাসে রেমিট্যান্স আসে। উভয়ের রোজগারে বন্ধুটি তার বাড়ি-ঘর পাকা করেছে। সচ্ছল জীবন-যাপন করেছে। একবার দেখা হলে ওর ঐসব কথা শুনলাম। জিজ্ঞেস করলাম ছোটটা কী করে। জানাল, ছোট ছেলেটিও সৌদি আরব যাওয়ার জন্য পাগল হয়েছে। দালাল ধরেছে। টাকা দিয়েছে। এখন ওর কাজ হচ্ছে স্কুলের লেখাপড়া বাদ দিয়ে দালালের পেছনে ঘুরা। উড়ু উড়ু মন, কবে সৌদি যাবে। এসব বলতে বলতে তার বর্তমান ঘর-সংসারের কথা বিস্তারিত বলল। আমি একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে তোমার জমি-জমার কী হবে? কে করবে জমি চাষ, কৃষি কাজ? ও বলল-কৃষি কাজ তো বন্ধই। আমার বয়স হয়েছে। আমি আর মাঠে কাজ করতে পারি না। ঢাকায় এক ছেলে, সৌদিতে এক ছেলে তাদের জমিতে কোনো উত্সাহ নেই। ছোট ছেলেরও মন নেই কৃষিতে। বস্তুত ও বলল, গ্রামের কৃষকরা এখন কৃষিকাজ আর করতে চায় না।

সেচের জলের অভাব, কৃষি উপকরণের অভাব, ঋণের সমস্যা, বাজারের সমস্যা, মালের দাম পাওয়া যায় না। সারের চিন্তা, বীজের চিন্তা। ঘাস নেই, গরু নেই, নদী, খাল-বিল নেই। গোবর নেই। কৃষিকাজ চালিয়ে যাওয়া এখন বড়ই কষ্টের। যাদের কোনো উপায় নেই তারাই কৃষি কাজে আছে। ‘ক’, ‘খ’ শিখলেই এখন বিদেশ যেতে চায়, চাকরি করতে চায়। এসব কথা শোনার পর থেকে আমি মেলাচ্ছিলাম। দেখলাম বন্ধুটির কথার গুরুত্ব আছে। আমি চাকরি জীবনে অনেককে পেয়েছি যারা চাকরির তদবিরে আসতেন। ছেলে-মেয়ে বিএ-এমএ পাস। বাপের জমিজমা আছে। মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার। সারা বছর খেতের ফসলেই তাদের চলে। বরং এর কিছু উদ্বৃত্ত থেকেই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া হয়েছে। কিন্তু ছেলেরা জমি-জমায় নিয়োজিত হতে চায় না। তারা চাকরি করতে চায়। বাপ-মা ও ছেলেরা চাকরিতে যাক তাই চায়। বিয়ে শাদির বাজারেও চাকরিজীবীর কদর বেশি। কৃষকের কৃষক ছেলে এমএ পাস হলেও তার কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি নয়। বস্তুত কৃষি ধীরে ধীরে এক অবাঞ্ছিত পেশায় পরিণত হচ্ছে। একান্ত যাদের গতি নেই তারাই মাঠে কামড় দিয়ে আছে। তাদের ভরসা ওপরওয়ালা। সরকারি কিছু সাহায্য তাদের নাককে জলের কিছুটা ওপরে রাখতে সাহায্য করছে। এটাই বাস্তব। অথচ এর থেকে পরিত্রাণ দরকার।

শত হোক চাল-ডাল ছাড়া বাঙালি বাঁচবে না। খাদ্য লাগবে শরীর রক্ষার জন্য, পুষ্টির জন্য, মেধার জন্য। দরকার নদ-নদী, খাল-বিল-নালা, দরকার গোবর, প্রাকৃতিক সার, দরকার গরু ও পশু, দরকার ঘাস। দরকার বৃক্ষরাজি যা অক্সিজেনও দেবে, জলও সংরক্ষণ করবে, সারও জোগাবে। কৃষির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এসব। অতএব জীববৈচিত্র্যের সবকিছু রক্ষণ যেমন দরকার, তেমনি দরকার কৃষিকে জিইয়ে রাখা। কৃষি একক কোনো বিষয় নয়। এর জন্য সাময়িকভাবে হয়ত ভর্তুকির দরকার। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কৃষি হতে হবে লাভজনক একটি পেশা। একে চিরকাল লোকসানি রেখে আমাদের বাঁচার চেষ্টা হবে বাতুলতা। এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে কৃষিতে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বিনিয়োগ কেন করবে? বিনিয়োগ হবে কৃষি লাভজনক হলেই। আবার বিনিয়োগ না হলেও কৃষি লাভজনক হবে না। এমন অবস্থাতেই চালের মূল্য ৪০ টাকা কেজির কথা এলো। সবারই ভাবার সময় এটা।

n লেখক :অর্থনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্তেফাক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়