শিরোনাম
◈ আবদুল্লাহ জাহাজে খাবার থাকলেও সংকট বিশুদ্ধ পানির ◈ কিছুটা কমেছে পেঁয়াজ ও সবজির দাম, বেড়েছে আলুর ◈ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় কোনো ভাষা জানেন না, সময় এসেছে তৃতীয় ভাষার ◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র

প্রকাশিত : ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৫:৫৭ সকাল
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৫:৫৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

জনগণকে ভয় দেখানোর রাজনীতি আর নয়

মাসুদা ভাট্টি : বাংলাদেশের জনগণ হওয়ার সবচেয়ে খারাপ দিক কী? এরকম একটি প্রশ্ন নিয়ে যদি আলোচনা শুরু করি তাহলে দেখতে পাই যে এদেশের নাগরিক হওয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে, এখানে কখনও ভীতিহীন, নির্ভীক হয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়। সব সময় এক ধরনের আতঙ্কের ভেতর এদেশের মানুষকে বসবাস করতে হয়। অনিশ্চয়তা এদেশের নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বা পুরস্কার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই আতঙ্ক বা ভীতি কোনও প্রাকৃতিক কারণে নয়, বরং এর সবটাই মানুষের সৃষ্টি। একদল মানুষ আরেকদল মানুষকে ভয়-ভীতির ভেতর রেখে ফায়দা লুটতে চায়, নিজেদের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
গত কয়েক দিনের ঘটনা বিশ্লেষণ করা যাক। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামে একটি মামলা দায়ের হয়েছিল ১/১১’র সরকারের আমলে। স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করার সুযোগ পেয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস তাকে মনে রাখবে। আমার অনেক লেখাতেই উল্লেখ করেছি, বেগম জিয়ার ১৯৯১ সালের সরকার বিএনপি নামক দলটিকে তার সেনাজাত অতীত থেকে সরাতে পারতো কিন্তু সেটা হয়নি। সেই আমলে জিয়া পরিবার দুর্নীতি করেনি বলেই এতদিন জানা ছিল, কিন্তু ১/১১’র সরকার এসে যখন ১৯৯২ সালের দুর্নীতি নিয়েই মামলা দায়ের করে তখন মনে হয়, আসলে ৯১’র বেগম জিয়ার সরকারও দুর্নীতিমুক্ত ছিল না। যাইহোক, দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে বিচারক যখন মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করলেন সেদিন থেকেই শুরু হলো এদেশের মানুষকে নতুন করে ভয় দেখানো। বিএনপি ও তার শরিক জামায়াতসহ অন্যান্য দল এমন হম্বিতম্বি শুরু করলো, যে কেউ মনে করতে পারেন বেগম জিয়াকে শাস্তি দেওয়া যাবে না, বেগম জিয়া আইনের ঊর্ধ্বে একজন মানুষ এবং তিনি কোনোই দোষ করতে পারেন না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিচারক কী রায় দেবেন তা কিন্তু আজ অবধি অজানাই।

অপরদিকে, বিএনপি’র চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সরকারে থেকেও যে কাজটি করলো তা আরও খারাপ। তারাও বিএনপি নেতাদের উসকানির জবাবে এমন বালখিল্য আচরণ শুরু করলো যে, যে কারও মনে হতে পারে এদেশের রাজনীতি আসলে এখনও শিশুই রয়ে গেছে। চকোলেট বা খেলনা নিয়ে শিশুরা যেমন একে অপরকে আক্রমণ/পাল্টা আক্রমণ করে, তেমনি বিএনপি-আওয়ামী লীগও বেগম জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে মন্তব্যযুদ্ধে নেমে পড়লো। এর মধ্যেই বিএনপি’র পক্ষ থেকে হঠকারী একটি কাজ করা হলো পুলিশকে আক্রমণ করে, তাদের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া এবং প্রিজন ভ্যান থেকে বিএনপি-কর্মীদের ছিনতাই করে নেওয়ার মাধ্যমে। সুযোগ তৈরি হলো সরকারের তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিএনপি নেতাকর্মীদের ঢালাও গ্রেফতারের। কিন্তু তার চেয়েও বড় ঘটনা হলো বিএনপি জনগণকে একটি মেসেজ দিলো পুলিশের কাছ থেকে এই কর্মী ছিনতাইয়ের মাধ্যমে। সেই মেসেজটি কী?

বিএনপি বলতে চাইলো যে, ৮ ফেব্রুয়ারি যদি বেগম জিয়াকে সাজা দেওয়া হয় তাহলে তারা দেশে চরম অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করবে এবং তারা বড় ধরনের নাশকতার পরিস্থিতি সৃষ্টিতেও পিছপা হবে না। ওদিকে সরকার তাদের দমনে যে কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণাও দিলো। আর এই দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি ঘোষণার মাঝখানে কে পড়লো, দেশের আপামর সাধারণ জনগণ। আমরা অতীতেও দেখেছি, এরকম রাজনৈতিক পক্ষের জনগণকে জিম্মি করার রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ে তৃতীয় কোনও শক্তি। অনেকেই বলতে চাইছেন যে, ৮ তারিখে যদি সেরকম কোনও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে বাংলাদেশে অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা দখলের পথ পরিষ্কার হতে পারে। আমি আজকের লেখায় সে ব্যাখ্যার দিকে যাচ্ছি না, আমি জনগণকে জিম্মি করে একটি ভয়ের পরিবেশের ভেতর রাখার এই রাজনীতি নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

আমরা জানি যে, অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেও প্রথমে জনগণকে ভয় দেখাতে শুরু করে। কখনও সামরিক আইন জারি করে কখনও অহেতুক রাজনীতিবিদদের জেলে পুরে কিংবা সবার আগে দুর্নীতি দমন বা রাস্তা পরিষ্কারের মতো কর্মসূচি দিয়ে। দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলেরই সে অভিজ্ঞতা অতীতে হয়েছে। নতুন করে সে কারণেই এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখনও, এই একুশ শতকে এসেও কেন জনগণকে ভয়ের ভেতর রেখে রাজনীতি করতে হচ্ছে। আজকে যখন এই লেখাটি লিখছি (৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) তখন অনেক পথচারীর চোখেমুখেই আতঙ্কের চিহ্ন দেখছি। টিভি চ্যানেলগুলোতে ক্যামেরার সামনে এসে সাধারণ পথচারী বলছেন, ‘আমরা ভয় পাচ্ছি রাস্তায় বেরুতে। আমাদের জিম্মি করে রাজনৈতিক দলগুলো ফায়দা লুটতে চাইছে’। জনগণের এই উপলব্ধি যে ভয়ঙ্কর তা কেন নতুন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাতে হচ্ছে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আজকের।

বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় যে, তারা আসলে ক্ষমতা ছাড়া আর কোনও কিছুই জানে না, বোঝে না। দীর্ঘ নয় বছর তারা ক্ষমতার বাইরে, এই নয় বছরে তারা এমন কোনও কর্মসূচি এখনও দেয়নি বা দিতে পারেনি যাকে আমরা বলতে পারি জনগণের জন্য সামান্য হলেও কল্যাণের। সরকারের শত শত কর্মকাণ্ড রয়েছে যা জনবান্ধব নয়, রয়েছে অনেক দুর্নীতি ও অ-কাজের উদাহরণও। কিন্তু সেসবকে জনগণের সামনে তুলে ধরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করার কাজটি যে বিএনপি এখনও শিখে উঠতে পারেনি তার প্রমাণ বেগম জিয়ার মামলার রায়কে নিয়ে সারা দেশে একটি আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরির ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জনগণ এখন বলতে শুরু করেছেন যে, এক ব্যক্তির দুর্নীতির মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপি যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে তাতে মনে হচ্ছে দলটি আসলে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং তারা কেবল ক্ষমতাকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে, জনগণ তাদের কাছে কোনও বিষয়ই নয়। কিন্তু যদি জনগণের ভোট পেতে হয় তাহলে জনগণের কাছে তো যেতে হবে, তাই না? কেবল সরকার তথা আওয়ামী লীগের ভুলের কারণে জনগণ তাদের বিকল্প সরকার হিসেবে ভাবছে ভাবলে তো চরম ভুল ভাবা হবে, তাদেরকেও তো প্রমাণ করতে হবে যে, তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কিছু জনগণকে দিতে পারবে। কই সেরকম কোনও পরিকল্পনা বা আশার কথা তো এতদিনও তারা জনগণকে শোনাতে পারেনি। উল্টো তারা এখন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তাদের দুর্নীতির আসামি নেতা বেগম জিয়াকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে জনগণের আস্থা এভাবেই যে ওঠে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই আর।

আর সরকার কী করছে? একের পর এক ব্যাংক-দুর্নীতির খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, ছাত্রলীগের কোন্দলে রক্তকাণ্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে– এসব সবকিছু বাদ দিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় নেতারা বিএনপি নেত্রীর দুর্নীতির মামলা নিয়ে আবোল-তাবোল কথা বলে চলেছেন। একটি বিচারাধীন মামলা নিয়ে যে কথা বলার এখতিয়ার কারোর নেই, সে প্রশ্ন করলে তারা বিএনপিকে দোষারোপ করেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দলীয় কর্মীদের মাঠে রাখার এই যে ঘোষণা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে সেটা আসলে জনগণকে ভয় দেখানোর মতোই। এতে তাদের উপকার কতটুকু হচ্ছে তা জানি না, কিন্তু অপকার হচ্ছে ষোলআনা। সরকারের অপকর্মকে ঢাকার জন্যই বেগম জিয়ার বিচার করা হচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন যদি কোনও নিরীহ জনগণ তোলে তাহলে তাকে কোনোভাবে দোষ দেওয়া যাবে কি? আমরা বিশ্বাস করি, বেগম জিয়ার দুর্নীতির বিচারের মতো সরকারের প্রকাশিত, অপ্রকাশিত, প্রকাশিতব্য সকল দুর্নীতির বিচার করে তবেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোট চাইতে নামবেন, না হলে জনগণ যখন প্রশ্ন করবেন, বেগম জিয়ার বিচার করলেন আপনাদের বিচার হলো না কেন? তখন কোনও উত্তর থাকবে কি আওয়ামী লীগের মুখে?

কিন্তু তার চেয়েও বড় যে কথাটি সরকার তথা আওয়ামী লীগকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছি তা হলো, দয়া করে জনগণকে আর ভয়ভীতির ভেতর ফেলবেন না। আইনকে, বিচার ব্যবস্থাকে স্ব-স্ব ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিন, মামলার রায়কে কেন্দ্র করে গণভীতি যদি গণরোষে পরিণত হয় তাহলে সেটা সামলানো সম্ভব হবে কিনা সেটা একবার ভেবে দেখবার অনুরোধ জানাই। বিএনপির এই মুহূর্তে হারানোর কিছুই নেই, কিন্তু সরকারের আছে, আওয়ামী লীগের আছে এবং সবচেয়ে বেশি আছে দেশের। যে উন্নয়নের স্বাদ আর স্বপ্ন জনগণকে আপনাদের নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে দেখিয়েছেন তা যদি দলীয়ভাবে আপনারা আরও দৃঢ়তার সঙ্গে জনগণকে দেখাতে না পারেন তাহলে সামনে আপনাদের জন্য দুর্দিন অপেক্ষা করছে। আওয়ামী লীগের দুর্দিন মানে দেশের দুর্দিন, জনগণের দুর্দিন–সেটা এখনও না বুঝতে পারলে সামনে আর বোঝার মতো কোনও সুযোগ আসবে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে।

আগামীকাল ৮ তারিখ, রাজনীতির জন্য, রাজনীতিবিদদের জন্য হয়তো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, কিন্তু দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যেন দিনটি ভয়ের না হয় সে দিকটি ভেবে রাজনীতিবিদরা সিদ্ধান্ত নেবেন, একুশ শতকে এসেও এই ভয়ভীতির রাজনীতি, দেশ আর দেশের সম্পদকে বিনষ্ট করার রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত না করতে পারলে কিসের উন্নয়ন? কিসের এগিয়ে যাওয়া? কিসের নিজেদের সভ্য ভাবা? সবই মিথ্যে,সবই বিনষ্ট হওয়ার দিন হবে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। তাই সকল পক্ষকে জনগণকে ভীতিমুক্ত রাখার নিবেদন জানাই।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়