ডেস্ক রিপোর্ট : কর্তব্যরত অবস্থায় ২২ জানুয়ারি রাতে দুর্ঘটনার শিকার হন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দৈনিক মজুরিভিত্তিক অস্থায়ী (ক্যাজুয়াল) শ্রমিক মো. মুখলেছুর রহমান। প্রায় ৩ টন ওজনের একটি কার্গো ট্রলির নিচে পা পড়ে মারাত্মক আহত মুখলেছুর এখন হাসপাতালে। তবে অস্থায়ী হওয়ায় তাকে কোনোরকম ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নয় বিমান। এমনকি তার চিকিৎসার খরচও বহন করবে না রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থাটি।
শুধু মো. মুখলেছুর রহমান নন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে প্রতিনিয়ত চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন প্রায় ২ হাজার ২০০ জন অস্থায়ী শ্রমিক। যদিও এসব শ্রমিকের ওপরই ন্যস্ত রয়েছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্ব। বিমানের পক্ষ থেকে কখনো এসব শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা না হলেও চাকরি স্থায়ীকরণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। মূলত চাহিদা অনুযায়ী অর্গানোগ্রাম (জনবল কাঠামো) না থাকা এবং ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাতে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ী করছে না বিমান।
এ অবস্থায় দুই যুগেও চাকরি স্থায়ী না করার প্রতিবাদে আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে সব ধরনের ওভারটাইম বন্ধের আলটিমেটাম দিয়েছেন বিমানে কর্মরত দুই সহস্রাধিক ক্যাজুয়াল শ্রমিক-কর্মচারীর পাশাপাশি স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীরাও। এমন পরিস্থিতিতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি দেশের সব বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ। কারণ বিমানবন্দরের দৈনিক মোট কাজের ৩০ শতাংশের বেশিই ওভারটাইমের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিমান শ্রমিক লীগের সভাপতি মশিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের প্রতিটি কাজই ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে প্রতি মাসেই কোনো না কোনো ক্যাজুয়াল শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু বিমান থেকে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। এমনকি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনে ছুটিও পান না তারা, যা অমানবিক।
ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ীকরণে অর্গানোগ্রাম জটিলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এতে প্রধান অন্তরায় মূলত বিমানের মানবসম্পদ বিভাগ। কারণ বিমান যখন করপোরেশন ছিল, তখনো গ্রুপ-১ শ্রমিক বা হেলপার ছিল। পিএলসি হওয়ার পর তাদেরকেই পি নম্বর ঠিক রেখে বিমানে রেখে দেয়া হয়েছে এবং তারা এখনো গ্রুপ-১ হিসেবে চাকরি করছে। কাজেই ম্যানেজমেন্টের সদিচ্ছা থাকলে যে কোনো ফরম্যাটেই এটা করা সম্ভব।
এদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি এসেনশিয়াল সার্ভিসেস অর্ডিন্যান্সের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কেউ দায়িত্ব পালন না করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে বিমান কর্তৃপক্ষ। ওভারটাইম না করার সিদ্ধান্তে এ আইন ভঙ্গ হবে কিনা জানতে চাইলে মশিকুর রহমান বলেন, শ্রমিকরা ধর্মঘট বা অনশনের মতো কর্মসূচিতে যাবে না। কাউকে জিম্মিও করবে না। শুধু ক্যাজুয়াল ও স্থায়ী শ্রমিকরা বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিদিন যে ওভারটাইম করছে সেটা বন্ধ রাখা হবে। এতে শ্রম আইন ভঙ্গ হবে না।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সূত্রে জানা গেছে, বিমানে প্রায় ২ হাজার ২০০ ক্যাজুয়াল শ্রমিক রয়েছে। এদের মধ্যে ৭০০ জন ১০ দিনের এবং বাকিরা ৮৯ দিনের চুক্তিতে নিয়োগ পান। মেয়াদ শেষ হলেই পরের দিনে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে হয়। এরপর আবার ১০ বা ৮৯ দিনের জন্য তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। মূলত বিমানের কার্গো সার্ভিস, গ্রাউন্ড সার্ভিস, ট্রাফিক, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মোটর ট্রান্সপোর্ট বিভাগে ক্যাজুয়াল শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা বিমানে পে-গ্রুপ-১ হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের একজন শ্রমিকের দৈনিক বেতন গড়ে ৪৯০ টাকা। মাসে ২২ দিন কাজ করার সুযোগ হিসেবে প্রতিজনের আয় হয় ১০ হাজার ৭৮০ টাকা। চাকরি স্থায়ী হলে প্রতিজনের পেছনে গড়ে আরো ৫ হাজার টাকা করে বেশি খরচ হবে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের বাইরে রেখেই পে-স্কেল ঘোষণা করে বিমান। স্থায়ী পদে একজন শ্রমিকের মূল বেতন ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু একজন ক্যাজুয়াল শ্রমিকের বেতন মাত্র ১২ হাজার টাকা। স্থায়ী শ্রমিকরা দুই ঈদে মূল বেতনের সমপরিমাণ বোনাস পেলেও ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের ২ হাজার টাকা বোনাস দেয়া হয়। স্থায়ী শ্রমিকদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতি হলেও এ সুবিধা পান না ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা। একই সঙ্গে স্থায়ী শ্রমিক কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হলে ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ভাতা, জীবন বীমা সুবিধা পেলেও ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া অসুস্থতার জন্য কোনো ছুটি পান না ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা। ২০০৭ সালে বিমানকে কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। কিন্তু এখনো অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত করা হয়নি।
বিমানের হিসাব শাখা সূত্রে জানা গেছে, বিমানের মোট (স্থায়ী ও ক্যাজুয়াল) জনবলের মাসিক বেতন বাবদ ব্যয় হয় ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ২০০ ক্যাজুয়াল শ্রমিকের বেতন হিসেবে ব্যয় হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। বাকি ৩৪ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয় বিমানের স্থায়ী জনবলের পেছনে। যদিও মোট জনবলের অর্ধেক স্থায়ী এবং বাকি অর্ধেক ক্যাজুয়াল।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএম মোসাদ্দিক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বিমানের নতুন অর্গানোগ্রাম চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে। সেখানে এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে নতুন অর্গানোগ্রাম অনুমোদন হলে এ বিষয়টির সমাধান হবে। সূত্র : বণিক বার্তা