সালমান রাফি : দাভোসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বক্তব্য রেখেছেন, সেটা নিয়ে ভারতের মিডিয়াগুলো বলেছে যে, শ্রোতারা যেটা শুনতে চেয়েছেন, সেটা শুনিয়েছেন মোদি। তবে খুব অল্প মানুষই খেয়াল করেছেন যে মোদি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে মার্কিন লাইনে হাঁটছেন। বিশেষ করে এশিয়াসহ সারা বিশ্বে চীনের প্রভাব বাড়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন করে জড়িয়ে পড়েছে ভারত।
সংরক্ষণবাদের বিরুদ্ধে এবং মুক্তবাজার ব্যবস্থার পক্ষে মোদির বক্তব্যে চীন যতই প্রশংসা করুক না কেন, মোদি শেষ পর্যন্ত “নীতি-নির্ভর” অর্থনীতির প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন। যে নীতিগুলো এসেছে যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে। যে অর্থনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বে নেতৃত্ব করছে।
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য দাভোসে অনেক কথা হয়েছে, যেটা ব্রিক্স (বি-আর-আই-সি-এস)-ভুক্ত দেশগুলো বহুদিন ধরে বলে আসছে। বড় বড় অর্থনীতি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন নিয়েও কথা হয়েছে। তবে মোদি যেভাবে তার বক্তৃতা সাজিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে ভারতকে চীনের মতো একটা “বড়” শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি, যারা বিশ্বকে আরও ভালোভাবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে চীনের শি-এর মতো নিজের মাতৃভাষাতেই ভাষণটা দিয়েছেন মোদি। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে শি চীনা ভাষাতেই বক্তৃতা করেছিলেন।
এটা ঠিক যে, ইংরেজি, চিনা, ফরাসী ভাষার সাথে সাথে হিন্দিকেও আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদায় নেয়ার চেষ্টা করেছেন মোদি। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতকে বড় দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা। একদিকে এশিয়ায় ভারতের উত্থানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বতায় রয়েছে একমাত্র চীন, যে কারণে দুই দেশ সামরিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
অন্যভাবে বললে, বড় শক্তিগুলোর দাবার ছকে এখন যে অবস্থানে রয়েছে ভারত, তাতে ভারত ছাড়া অন্য যে দেশটির লাভ হবে সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন কখনই নয়।
ভারতের এই উত্থানে চীনের উদ্বিগ্ন হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। ভারতের উপর সেভাবে নজরও রেখেছে তারা। মজার ব্যাপার হলো মোদির বক্তৃতার মাত্র একদিন পরেই চীন দেখলো যে ভারত তাদের ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের (আইসিবিএম) পরীক্ষা চালিয়েছে। এবং ভারতীয় মিডিয়াগুলো গর্বের সাথে জানিয়েছে যে, ভারতের প্রথম আইসিবিএম চীনের সবচেয়ে উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। এর অর্থ হলো বেইজিং, সাংহাই, গুয়ানঝুসহ চীনের প্রধান শহরগুলো ভারতীয় মিসাইলের আওতার মধ্যে পড়ে।
অবশ্যই, নরেন্দ্র মোদি যখন সংরক্ষণবাদের বিপক্ষে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের স্বপক্ষে কথা বলেছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের গালে থাপ্পর পড়েছে। তবে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রমঞ্চে টিকে থাকার ভারতের এই পুরনো কৌশলের সাথে সবাই পরিচিত। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: কেন স্বঘোষিত বিশ্বশক্তি ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাদের শর্তহীন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে? অন্য কথায়, দাভোসে মোদির কথার মারপ্যাঁচের আড়ালো অন্য কোন উদ্দেশ্য রয়েছে।
তবে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা কি হবে, দাভোসে সে বিষয়ে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছেন রাজনৈতিক বুলির ওস্তাদ মোদি।
তার বক্তব্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো ভারতের গণতান্ত্রিক বৈচিত্র, যেটাকে অস্থিতিশীল বিশ্বের প্রেক্ষাপটে একটা অগ্রগতি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য এখনকার মতো আর কখনোই এতো প্রশ্নের মুখে পড়েনি। শুধু তথ্যচিত্রের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়।
১৯৫৭ সালের পর মোদি সরকারের পার্লামেন্টে এই প্রথমবারের মতো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব সবচেয়ে কম। ভারতের ১৪.২ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার কথা বিবেচনায় নিলে পার্লামেন্টে অন্তত ৭৭ জন মুসলিম প্রতিনিধি থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা আনুপাতিক চিত্রের পুরো উল্টা- এখন মুসলিম প্রতিনিধির সংখ্যা মাত্র ২৩ জন।
মোদির ৬৬ সদস্যের বর্তমান মন্ত্রিসভায় মাত্র দু’জন মন্ত্রী মুসলিম। এটাকেই হয়তো মোদির সমর্থকরা বৈচিত্র মনে করতে পারেন কারণ মোদি যখন ১২ বছর ধরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তার মন্ত্রিসভায় একজনও মুসলিম মন্ত্রী ছিল না।
কিভাবে এরকম একজন ব্যক্তি, বৈচিত্রকে স্থান দেয়ার ব্যাপারে যার কোন অর্জনই নেই, তিনি ভারতের বৈচিত্রকে স্থিতিশীলতার শক্তি হিসেবে গর্ব করতে পারেন?
কিন্তু দাভোসে তিনি ভারতের ‘মহান’ গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতাকে চীনের একদলীয় ব্যবস্থার পাশে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন, যাতে বিশ্বের কাছে নিজেদের তুলে ধরা যায়।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দাভোসে ভারতের শক্তির কথা বলতে গিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন – “বৈচিত্রের মধ্যে একতা”, যদি এই কথাগুলো দেশে আরও বেশি বলতেন তিনি, তাতে ভারতের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় সেটা আরও সাহায্য করতো। কিন্তু দেশে তিনি ভিন্ন মানুষ।
আর ভারত যদি দেশের ভেতরে এই কথাগুলো আরও বাস্তবসম্মত ও স্পষ্ট ভাষায় না বলে, তাহলে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে নিজেকে প্রদর্শনের ইচ্ছা হাস্যকর এবং অবাস্তব গল্পই থেকে যাবে, বাস্তবতার সাথে যার কোন মিল নেই।
কিন্তু সেটা মোদির লক্ষ্য ছিল না। সেখানে তিনি গেছেন ভারতের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা জোর গলায় বলতে যাতে ভারতীয় সমাজের ক্রমবর্ধমান চরমপন্থী মনোভাবের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাখা যায়। এবং ২০১৮ সাল নাগাদ ভারত পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠছে বলে যত দাবিই করা হোক না কেন, ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্টটি এখনও আমাদের সামনে রয়েছে, যেখানে “ব্যবসায়ের সহজলভ্যতার” মাপকাঠিতে ১৯০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান হলো ১৩০তম। রাজনৈতিক সংঘাত এবং এর সাথে জড়িত অনিশ্চয়তার কারণেই এই অবনতি হয়েছে তাদের। কিন্তু দাভোস এ ব্যাপারে কিছুই জানে না।- সাউথ এশিয়ান মনিটর।