মোস্তফা আরিফ : একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকও প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর মাত্র দুই বছর পর একুশ শতকরে দ্বিতীয় কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। সারা বিশ্বের মানুষের মনে নতুন করে প্রশ্ন জেগেছে এই বিশ্বায়নে কি লাভ হয়েছে? এর ফলে বড় ধরনের একটি ক্ষতি হয়ে গেছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের বাজার ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেছে, উন্নত বিশ্বের পণ্য তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখল করে বসে আছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ দেউলিয়ার শিকার হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের ফলে বাজার ব্যবস্থায় প্রকাশ্যে অসমতা সৃষ্টি হয়েছে। অগ্রসরমান অর্থনীতিতে এই অসমতা শাপে বর হয়েছে- উন্নয়নশীল বিশ্বের বাজার ব্যবস্থা পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে উঠতে পারে নি বিধায় বিদেশী পণ্যের বাজার অবাধে ঘটছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ফলে অসমতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্প্রতি অর্থনৈািতক অসমতা সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৮০ সালে শতকরা ১১ ভাগ মানুষের আয়- ব্যয়ের মাঝে বিরাজমান পার্থক্য ছিল কিন্তু ২০১৪ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ ভাগ। তাহলে ৩৪ বছরে শতকরা ৯ ভাগরেও বেশি মানুষ হত দারিদ্র্য হয়ে গেছে। এই হচ্ছে বিশ্বায়নের আপাত দৃষ্টিতে সুফলের নমুনা! এই চিত্র বিশ্ব অর্থনীতির এক অন্যতম শক্তি হিসাবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্রের। ফ্রান্স, জার্মানী এবং ইংল্যান্ডের অবস্থাও একই রকম।
অসমতা আর অর্থনৈতিক ভারসামহীনতা- এ শুরু হয়েছে বিশ শতকের ৮০ দশকে, এর পিছনে মৌলিক দিক হচ্ছে বানিজ্যে প্রবল ঘাটতি, পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উন্নত বিশ্বের সাথে তৃতীয় বিশ্বকে অলিখিত প্রতিযেগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য করা, শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের শ্রম বাজারে ব্যাপক কর্মহীনতা, এসব কিছুই হযেছে বিশ্বায়নের নামে। কিন্তু এ প্রশ্নও জাগতে পারে অর্থনৈতিক অসমতার পিছনে বানিজ্য ব্যবস্থা কি পুরোপুরি দায়ী? এ ব্যাপারে সংশয় থেকেই যায়। সংশয়ের যথেষ্ঠ কারণও আছে বৈকি। আজ থেকে দশ বছর আগে ২০০৮ সালে বিশ্ব বাণিজ্যে জিডিপির পরিমাণ ছিল শতকরা ৬১ ভাগ কিন্তু ২০১৬-তে এসে দাঁড়ায় শতকরা ৫৬ ভাগ। বাণিজ্য ঘাটতি শতকরা ৬ ভাগ ছাড়িয়ে যায়। রাজনীতিবিদদের মাঝে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের নেতৃবৃন্দ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ভুলত্রুটি তুলে ধরে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জেভিয়ার মার্টিন ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ফলে অর্থনীতি এবং বাণিজ্যে কতটা ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে তার একটি প্রাথমিক চিত্র প্রদর্শন করেছেন। তার মতে উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিটি দেশ বাণিজ্যে অসমতা সৃষ্টি হয়েছে শতকরা ১০ ভাগ, পণ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে শতকরা ১৫ ভাগ, বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু ভারত এবং চায়নায় পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিজস্ব নীতি প্রচলনের ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের সাথে তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থেকেছে এবং ১৯৮০ সালের পর থেকে এই দুই দেশের মাথাপিছু আয় প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চায়না এবং ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির পিছনে নগরায়ন, অতিমাত্রায় সঞ্চয় প্রবৃত্তি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসরমানতাই এর প্রধান কারণ। এ দুই দেশ বিশ্ব বাণিজ্যে ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক অসমতাকে পিছনে ফেলে দৃঢ়পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একথা সত্য, বাণিজ্য হচ্ছে এশিয়ার অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল চালিকা শক্তি।
এশিয়ার এই অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণেই উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং উন্নত বিশ্বের বাজার ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও সামঞ্জস্য বিদ্যামান।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী
সম্পাদনা : খন্দকার আলমগীর হোসাইন
আপনার মতামত লিখুন :