ডেস্ক রিপোর্ট : পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ আটকে আছে ঋণচুক্তির আলোচনায়। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের দেড় বছর পরও চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি করা সম্ভব হয়নি। ঋণের টাকা না পাওয়ায় থমকে আছে সরকারের অগ্রাধিকারের (ফাস্র্দ্ব ট্র্যাক) এ প্রকল্পটি। সরকারি বরাদ্দের টাকাও ফেরত যাচ্ছে কাজ শুরু করতে না পারায়। ডিসেম্বরে ঋণচুক্তি হবে- এমন সম্ভাবনার কথা বলা হলেও, হয়নি। কবে চুক্তি হবে, তাও এখন আর নিশ্চিত নয়। দ্রুত চুক্তির তাগিদ দিতে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের দল যাচ্ছে চীন।
পদ্মায় সেতুর কাজ প্রায় ৫১ ভাগ শেষ। মূল সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৫৬ শতাংশ। পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হলেও, সেতুতে ট্রেন চলাচলে 'পদ্মা রেল সংযোগ' প্রকল্পের অগ্রগতি গত ২৪ মাসে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। কাগজে-কলমে ২০১৬ সালের প্রথম দিনে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতিও শূন্যের কাছাকাছি।
প্রকল্প সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ঋণচুক্তি না হওয়ায় এমন দুরবস্থা। ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার এ মেগা প্রকল্পে বার্ষিক দুই শতাংশ সুদে চীন ঋণ দেবে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। বাকি ১০ হাজার ২৩৯ কোটি জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার (জিওবি)। জিটুজি ঋণের শর্তে চীনের মনোনীত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড বিনা দরপত্রে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ পেয়েছে। ২০১৬ সালের আগস্টে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে নির্মাণ চুক্তি সই হয়।
নির্মাণ চুক্তি হলেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কয়েক দফা চীন সফর, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যোগাযোগের পরও নিশ্চিত নয় কবে ঋণ চুক্তি হবে। এই দেড় বছরে একের পর এক 'প্রয়োজনীয়' কাগজপত্র চেয়েছে ঋণদাতা চীনা এক্সিম ব্যাংক। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক জানিয়েছিলেন মার্চে ঋণ চুক্তি হবে। এপ্রিলে কাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। গত নভেম্বরে জানানানো হয়, ডিসেম্বরে চুক্তি হবে। কিন্তু মাসের শেষ দিকে চীনা এক্সিম ব্যাংক আবারও প্রয়োজনীয় 'ডকুমেন্ট' চায় ইআরডির কাছে।
ইআরডির অতিরিক্ত সচিব (এশিয়া উইং) জাহিদুল হক জানিয়েছেন, চুক্তি সইয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন তারা। প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ। এ বিশাল অর্থের চুক্তি করতে স্টেট কাউন্সিলের অনুমোদন প্রয়োজন বলে জানিয়েছে চীন। এ বিষয়ে আলোচনা করতে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, রেল সচিব মোফাজ্জেল হোসেনসহ সাত সদস্যের প্রতিনিধি দল চীন যাচ্ছে।
চুক্তির মতো এ সফর নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে ইআরডি সূত্র জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সফরসূচি ও প্রতিনিধি দল অনুমোদন করেছে। কিন্তু এখনও চীনা এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। ২১ জানুয়ারি প্রতিনিধি দলের চীন যাওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে গেছে এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে সময় না পাওয়ায়। জাহিদুল হক জানিয়েছেন, চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের সময় সূচি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তাদের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। জবাব পেলে, চীন রওনা হবে প্রতিনিধি দল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পদ্মা রেল সংযোগের কাজ শেষ হবে। প্রথম ধাপে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ, মাওয়া, পদ্মা সেতু, জাজিরা হয়ে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়া প্রকল্পে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
ঋণের টাকা না পাওয়ায় প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দের অংশও ফেরত যাচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে পদ্মা রেল সংযোগে সাত হাজার ৬০৯ কোটি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ঋণ বাবদ চার হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। জিওবিতে দুই হাজার ৬৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ঋণ বাবদ এক টাকাও পাওয়া যায়নি। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রকল্পে ছাড় করা হয়েছে ৬৬২ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সময়ক্ষেপণ হলেও চীনের ঋণের আশা বাদ দিয়ে নতুন অর্থায়নের সন্ধান করা যাচ্ছে না। এ প্রকল্পে আগ্রহী ছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তাদের পরিবর্তে চীনকে বেছে নেওয়া হয়। এখন চীনকে বাদ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে আবারও দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়নের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এতে দুই বছর সময় লেগে যাবে। তাই চীনকে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না।
রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক এখনও আশাবাদী শিগগির ঋণচুক্তি হবে। তিনি বলেছেন, দ্রুত চুক্তি সইয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সকল ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ঋণের টাকা না পেলেও নিজস্ব অর্থায়নে ভূমি অধিগ্রহণর ও অন্যান্য কাজ এগিয়ে রাখা হয়েছে। ঋণের টাকা পেলে পুরো গতিতে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
তবে রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চুক্তি হওয়া মাত্র ঋণের টাকা পাওয়া যাবে, তেমন নিশ্চয়তা নেই। এরপর 'লোন ইফেক্টিভ' এগ্রিমেন্ট করতে হবে। কর্ণফুলী টানেলও জিটুজি ঋণে হচ্ছে। চুক্তি সইয়ের ১০ মাস পর টাকা পাওয়া গেছে। চলতি শুস্ক মৌসুমে কাজ শুরু করতে না পারলে নভেম্বরের আগে শুরুর সম্ভাবনা নেই বলে ইআরডির প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
'পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প'-এ ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে নড়াইল, যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। ব্যয়ের হিসাবে এটি যোগাযোগ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের জুনে প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার কথা। সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :