শিরোনাম
◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে

প্রকাশিত : ২১ জানুয়ারী, ২০১৮, ১০:৩৫ দুপুর
আপডেট : ২১ জানুয়ারী, ২০১৮, ১০:৩৫ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রাজনৈতিক পরিচয়ে চলছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের চাঁদাবাজি

//*ধরন পাল্টেছে, রাজনৈতিক শেল্টারে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা *ইয়াবা ব্যবসার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে আন্ডারওয়ার্ল্ড//

ডেস্ক রিপোর্ট  : রাজধানীর সংঘবদ্ধ আন্ডারওয়ার্ল্ডের শুরুটা ছিল আশির দশকে। চাঁদাবাজির সীমানা নিয়ে আধিপত্যকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল সেভেন স্টার, ফাইভ স্টারের নামে সন্ত্রাসী গ্রুপের। দিন দুপুরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে চলতো এ সব সন্ত্রাসীর অস্ত্রের মহড়া। রমনা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কাফরুল ও পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় বোমাবাজি ছিল নিত্যদিনের চিত্র। ব্যবসায়ীরা টু শব্দ না করে পৌঁছে দিত মোটা অংকের টাকা। এ সময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটনের সবচেয়ে পুরনো কর্মকর্তা বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ড আগের মতো নেই। তবে অনেকেই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম করে ভয়ে দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে থাকে। এটি রীতিমত প্রতারণা। আর কেউ চাঁদা দিয়ে থাকলেও থানায় অভিযোগ করার রেকর্ড খুব একটা দেখা যায় না। নব্বই দশকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের যে অবস্থা ছিল, তা এখন নেই। রাজনৈতিক শেল্টারে হয়তো প্রভাব পড়তে পারে।’

আন্ডারওয়ার্ল্ডে চাঁদাবাজির পাশাপাশি ইয়াবা ব্যবসার নেটওয়ার্ক এখন এদের হাতে নিয়ন্ত্রিত। ঢাকাসহ সারাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এখন এই নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। এলাকায় ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শেল্টারে। ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় ব্যবহার করে প্রকাশ্যে তারা এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের পদবিতে আসীন থাকার কারণে পুলিশ একেবারে অসহায়।

বিভিন্ন জেলার থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দলীয় পরিচয় থাকার কারণে এদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। বিভিন্ন রুট ব্যবহার করে দেশে আনা হচ্ছে ইয়াবা। ইয়াবা আনার রুটগুলোও আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাতে নিয়ন্ত্রিত। আন্ডারওয়ার্ল্ডের চাঁদাবাজির নতুন স্থান ইয়াবা ব্যবসার সিন্ডিকেট। দুই বছর আগে রাজধানীর কলাবাগান এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ইয়াবাসহ পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক বছরের জেল দেয়। ওই ঘটনার পর ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ড জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ।

মাদক নিয়ন্ত্রণ ঢাকা মেট্রো-উপ অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (উত্তর) খুরশীদ আলম বলেন, ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা প্রথমে ইয়াবা সেবন করে। আসক্ত হওয়ার পর তাদের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটা যোগাযোগ হয়। পরে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তাদের নেটওয়ার্ক টিকিয়ে রাখতে এসব সন্ত্রাসীকে একটি মাসোহারা দেয়।’

এক সময়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন এক ব্যক্তি জানান, পুরনো সন্ত্রাসীরা এখন নানা কারণে পুরোপুরি চুপ হয়ে গেছে। তবে তাদের অনেকের নামে এখনো চাঁদাবাজি হয়। কিন্তু দেশের বাইরে থেকে সক্রিয় রয়েছে খিলগাঁওয়ের জিসান, মিরপুরের শাহদাত, লিটু, কাওরানবাজারের আশিক, কল্যাণপুরের বিকাশ-প্রকাশ, বাড্ডা এলাকার মেহেদী হাসান, যাত্রাবাড়ীতে ইটালি নাসির, জুরাইনের কচি, মগবাজারে রনি, শাহ আলী এলাকায় গাজী সুমন, আদাবরে নবী, মোহাম্মদপুরে কালা মনির, পল্লবীতে মোক্তার বাহিনী ও কাফরুলে শাহীন সিকদার। এদের হাত ধরে বাড্ডা এলাকায় ডালিম, রবিন, ভাগ্নে ফারুক, আরিফ, মান্নান, রমজান, দুলাল, মানিক, সিপলু, রায়হান, রুবেল, রিয়াদ, খিলগাঁওয়ে খালেদ, মানিক, রামপুরায় কালা পলাশ, মুরাদ, গুলশান-বনানী এলাকায় টিপু, যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ এলাকায় জাহাঙ্গীর, সায়েম আলী, মহাখালী এলাকায় অপু, মিলন, জামাই মুকুল, সাততলা বস্তিতে মনির, লম্বু সেলিম, হাজারীবাগে বুলু, লিংকন, তপু, জনি, রফিক, বিল্লু, মুন্না, কলাবাগান এলাকায় নাজিম বাবু, ইমন, মোহাম্মদপুরে গালকাটা মোশারফ, লম্বা মোশারফ, চিকা জসিম, আহম্মদ, সাজ্জাদ, মোহন, পাভেল, লোটন, চাইনিজ তানভীর, রবিন, আদিত, মীম, খলিল, হাজী আক্কাস ও শাহ আলীতে বল্টু রাসেল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।

তিনি আরো বলেন, ‘রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে যারা আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করেন তারা সবাই সরকার দলীয় একটি অঙ্গসংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেতা। এ কারণে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার খুব একটা চোখে না পড়লেও মোবাইল ফোনে অথবা ক্যাডারের মাধ্যমে খবর পাঠিয়ে চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয়। এসব নির্দিষ্ট ক্যাডার বা দলনেতার কাছে বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীরা চাঁদা পৌঁছে দেন।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। কয়েকজন কারাবন্দি রয়েছে। কয়েকজন সন্ত্রাসী বিদেশে আত্মগোপন করেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করে দেশের অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা কিছু করার। আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক আছি। এখানে তাদের কোনো সাগরেদ না থাকলে বাইরে থেকে অপারেশন বা তত্পরতা চালানো সম্ভব হয় না। বাইরে থেকে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। আন্ডারওয়ার্ল্ড রাজনৈতিকনির্ভর হয়ে গেছে- এমনটা আমাদের কাছে মনে হয়নি।’

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের উত্থান

আশির দশকের শেষ ভাগে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে প্রথম সংঘবদ্ধ ভাবে গড়ে ওঠে সেভেন স্টার বাহিনী। এ গ্রুপের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিল রমনা এলাকার আরমান (বর্তমানে কারাগারে)। এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ ছিল রমনা, রামপুরা, খিলগাঁও, লালবাগ ও তেজগাঁও এলাকা। পরে সুব্রত বাইনের সঙ্গে বিরোধ বাধে আরমানের। পরবর্তীতে ফার্মগেট, কাওরানবাজার ও রাজাবাজার এলাকাকে ঘিরে গড়ে ওঠে ফাইভ স্টার গ্রুপ। তবে ফাইভ স্টার ও সেভেন স্টার গ্রুপের মত যত সন্ত্রাসী গ্রুপ ছিল, তাদের বিশেষভাবে কোন দলীয় পরিচয় খুব একটা ছিল না। তাদের নাম শুনলে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন।

নব্বইয়ের দশকের পর এসে আন্ডারওয়ার্ল্ডে যুক্ত হয় রাজনীতি। স্ব স্ব এলাকার কর্তৃত্ব ধরে রাখতে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে থাকে হঠাত্ রাজধানীতে সক্রিয় হয়ে ওঠা নেতারা। পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে শুরু করে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত হয় সোনা চোরাচালান। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেক নামি দামি ছাত্র নেতার বড় আয়ের উত্স হয়ে দাঁড়ায় সোনা চোরাকারবারিরা। উত্তরা এলাকার টোকাই সাগর গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করত বিমানবন্দরের সোনা চোরাচালানি। তবে নব্বই দশকের আন্ডারওয়ার্ল্ডের আয়ের একটি ক্ষেত্র তৈরি হয় মাদক ব্যবসা (ফেনসিডিল)।

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান

রাজধানীর আগারগাঁও বিএনপি বস্তি ও কমলাপুর টিটিপাড়া বস্তি। প্রতিদিনই এই দুই বস্তি ঘিরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটতো। নিহত ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এসময় থেকেই শুরু হয় গার্মেন্টসের ঝুট নিয়ে কাড়াকাড়ি। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার গঠনের পরই সরকার প্রথম দফায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। ফলে এরপর থেকে স্টার গ্রুপ বিলুপ্ত হয়ে বহুল প্রচারিত শব্দ হয়ে দাঁড়ায় শীর্ষ সন্ত্রাসী। সময়ের প্রয়োজনে তৈরি হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ( প্রথমে এ বাহিনীর নাম ছিল র্যাট)। ২০০৪ সালে শুরু হয় ক্রসফায়ার। কাওরানবাজারের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান ক্রসফায়ারের মধ্য দিয়ে র্যাবের এই কার্যক্রম শুরু হয়। এরপরই ভাঙতে থাকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ছোট বড় গ্রুপ। আন্ডারওয়ার্ল্ডের পাতি সন্ত্রাসী থেকে বড় সন্ত্রাসীদের সিংহভাগই পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবে পালিয়ে থাকলেও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি থেমে থাকেনি। আর এসময় থেকে প্রচলিত হয় মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজি।

ক্ষমতাসীনদের ছাঁচে পালাবদল

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া অনেক সন্ত্রাসী অন্যদেশে পাড়ি জমায়। কেউ কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়ে দেশে ফিরে ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করে। ‘গুণগত’ পরিবর্তন শুরু হয় আন্ডারওয়ার্ল্ডে। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত আন্ডারওয়ার্ল্ডের মুখোমুখি বড় কোন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তবে অতীত ভোল পাল্টিয়ে সবাই ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছায়ায়’ সাজিয়েছে ‘ভিন্ন মেজাজের’ আন্ডারওয়ার্ল্ড। টেন্ডার নিয়ে আগে যেমন গ্রুপে গ্রুপে মহড়া চলতো, কিন্তু টেন্ডার অনলাইন কেন্দ্রিক হওয়ায় তা অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলছে চাঁদাবাজি। তবে এ জন্য অস্ত্রের মহড়ার কোন প্রয়োজন হয় না। ভুক্তভোগীরা ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে এখন আর থানা পুলিশের দারস্থ হয় না।

পুলিশকেও এখন এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। তবে আগের মতোই থানা পুলিশের রয়েছে সন্ত্রাসী তালিকা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজনৈতিক বা অন্য কোন কারণে থানায় যাদের বিরুদ্ধে বেশি মামলা থাকে তাদেরই দিয়ে পুলিশ তৈরি করছে সন্ত্রাসী তালিকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়