শিরোনাম
◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ চলচ্চিত্র ও টিভি খাতে ভারতের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলেই ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো ◈ মুজিবনগর সরকারের ৪০০ টাকা মাসিক বেতনের কর্মচারি ছিলেন জিয়াউর রহমান: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রকাশিত : ২১ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৭:০৪ সকাল
আপডেট : ২১ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৭:০৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দুর্দিনের রাজনীতিকরা উপেক্ষিত, পেশাজীবিদের কদর বেড়েছে

কেএম হোসাইন : জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকেও শেষবেলায় এসে দল থেকে উপেক্ষিত রয়েছেন অনেক প্রবীণ, পোক্ত ও পেশাজীবী রাজনীতিক। মহানগর থেকে শহর, মফস্বল থেকে তৃণমূল— বিএনপির প্রায় সর্বত্রই জায়গা হারাচ্ছেন বেশিরভাগ রাজনীতিক। তাদের দীর্ঘদিনের উর্পাজিত অবস্থান চলে যাচ্ছে অর্থশালী তরুণদের দখলে।

আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার করছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন তিনি। একইভাবে দলটিতে আরও প্রকট হতে যাচ্ছে পরিবারতন্ত্রের ধারাবাহিকতা। এর প্রভাব দেখা যেতে পারে আগামী জাতীয় নির্বাচনে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতি থেকে পেশাদার রাজনীতিকরা হারিয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্র পরিচালনায়। দলের ভেতরে আন্তঃকোন্দল, পেশীশক্তির ব্যবহার, টাকা-পয়সার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের পেছনে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের অংশগ্রহণকে দায়ী করছেন পর্যবেক্ষকরা।

বিএনপির ভুক্তভোগী রাজনীতিকরা দৃশ্যত এ নিয়ে কথা বলতে না চাইলেও কেউ-কেউ মনে করছেন, রাজনীতিকরা মূল্যায়িত না হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে জাতীয় সংসদে। এ কারণে দেশ ও জনগণের কল্যাণকে গুরুত্ব দেন না মূলধারার রাজনীতির বাইরে থেকে আসা অনেক পেশাজীবী। উল্টো আইন পাস বা দেশ পরিচালনায় নীতির ব্যবহার বাদ দিয়ে কাবিখা, গম ও রাষ্ট্রের সম্পত্তি লুটপাটের দিকে ঝুঁকে পড়েন তারা।

বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে বিভিন্ন পেশা থেকে আসা ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তাভাবনা এগিয়ে নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে প্রবাসী কয়েকজন নেতা, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীদের সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের মধ্যে একজনকে নিশ্চিত করা হয়েছে ময়মনসিংহ জেলার একটি আসনের জন্য। খালেদা জিয়ার এই আগ্রহের প্রতিফলন ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট নির্বাচনেও। সেখানে শিক্ষকদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়েছে বিএনপি সমর্থিত প্যানেলে।

অন্যদিকে পেশাদার রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক কাজী আসাদ জীবনের শেষ দিকে এসে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন ধীরে ধীরে। ছাত্রজীবন থেকে বিএনপির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই নেতা কখনোই সংসদ সদস্য হতে পারেননি। বর্তমানে তিনি পালন করছেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টার দায়িত্ব। অসুস্থ এই নেতার নির্বাচনি এলাকা গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া। গত নির্বাচনে প্রার্থিতা করার কথা থাকলেও করেননি। এমনকি আগামী নির্বাচনেও তার অংশগ্রহণ প্রায় নেই বললেই চলে।

কথায়-কথায় নিজের অভিব্যক্তি জানালেন কাজী আসাদ বলেন, ‘রাজনীতি এখন বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। অধিকাংশ রাজনীতিবিদ কিছু পাওয়ার আশা করেন। আর আমি রাজনীতির পেছনে ঘুরে তো নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমার বাবার ফিন্যান্সিয়াল সলভেন্সি ছিল বলে রাজনীতিতে যুক্ত থাকতে পেরেছি ২৪ ঘণ্টা।’

কাজী আসাদের বেশিরভাগ সময় এখন কাটে শুয়ে-বসে। ভারত-বাংলাদেশ ছুটোছুটি করে রোগ সারাই না হলেও তার ব্যবসা বছরখানেক ধরে বন্ধ রয়েছে। এ কারণে তার খেদোক্তি, ‘ভাবছিলাম আগামী নির্বাচন করবো। কিন্তু শরীরের যে অবস্থা তাতে আর সেই সুযোগ নেই।’

স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোক্তাও কাজী আসাদ। জীবনের পুরোটা সময় ধরে বিএনপির প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক, গবেষণা সেলের প্রধানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নিজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে যতটা ঋদ্ধ হয়েছেন, সংসদীয় রাজনীতিতে দল থেকে প্রত্যাখ্যাতও হয়েছেন সমপরিমাণ।

বিএনপি থেকে একরকম হারিয়ে গেছেন সানাউল হক নীরু। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) উপনির্বাচনে প্রার্থিতা চাইতে গিয়ে অবমূল্যায়িত হয়েছেন ছাত্রদলের একসময়ের একনিষ্ঠ নেতা ড. আসাদুজ্জামান রিপন। সবশেষ কাউন্সিলে তাকে দেওয়া হয়নি কোনও সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব। তার ঘনিষ্ঠরা বলছেন, ‘ডিএনসিসিতে প্রার্থী না করলেও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থিতা করার বিষয়ে উচ্চপর্যায় চাইলে তাকে প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দিতে পারতো।’

ড. আসাদুজ্জামান রিপন এ বিষয়ে নিজে মন্তব্য করতে রাজি না হলেও কাজী আসাদ বললেন, ‘তিনি তো ভালো, লেখাপড়া জানেন। তার মনোনয়ন পাওয়া দরকার ছিল। না পাওয়ার কারণ আছে। ঢাকা সিটিতে নির্বাচন করতে হলে যে ফান্ড অ্যান্ড ফিন্যান্স দরকার, তা কমতি আছে তার। উচ্চপর্যায় হয়তো এটা ধারণা করছে। এজন্য হয়তো তিনি পাননি। তবে তার পাওয়ার দরকার ছিল।’

কেন্দ্রে নীরু-রিপনের মতো মফস্বল-জেলা শহরগুলোতেও রাজনীতিকরা পেশাজীবীদের কাছে নিজেদের জায়গা হারাচ্ছেন। এরশাদ সরকারের সময় আন্দোলনে সম্পৃক্ত ১৯৮৬ থেকে ’৮৯ সালে সারাদেশের ছাত্রসংসদগুলোর প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর অনেকে রাজনীতিতেই স্থায়ী হতে পারেনি। দল থেকে কেউ পাননি পর্যাপ্ত মূল্যায়ন। ঢাকার বাইরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোতে ছাত্রদলের একাধিপত্য থাকলেও সেই সময়কার কোনও নেতাকেই বিএনপিতে বড় অবস্থানে আসতে দেখা যায়নি। নব্বই দশকে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এই পরিবর্তনের সূচনা হয়। এর মাধ্যমে দলে যুক্ত হন ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, প্রকৌশলীসহ অন্য পেশার ব্যক্তিরা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ভাষ্য, ‘রাজনীতিবিদদের হাতে এখন আর রাজনীতি নেই। বিরাট একটা পরিবর্তন এসে যাচ্ছে বা এসে গেছে। রাজনীতিবিদ বলতে আমরা যেটা বোঝাই এখন তা নেই। এখন কে কত টাকা বানাতে পারবে, সেই লোভ-লালসার লড়াই।’

আগামী দিনে এর প্রভাব কেমন হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এই ধারা শুরু হয়ে গেলে পরবর্তী সরকার সেভাবেই চলবে। সত্তরের বেশি সংখ্যক ব্যক্তি ব্যবসার পর রাজনীতি করে। রাজনীতি হচ্ছে সমাজে স্বীকৃতিলাভের বাহন। সমাজসেবা, মানুষের সেবা করা— এসব বিষয় এখন আর এতে নেই।’

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, খোদ বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকেই অনেককে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজপথে সক্রিয় থাকার চেয়ে পারিবারিক ও অভ্যন্তরীণ সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি মুখ্য হয়ে এসেছে। যে কারণে দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও সংসদীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার কোনও সুযোগ নেই অনেক ত্যাগীনেতার সামনে। বিষয়টি নিয়ে একাধিক জেলা কমিটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, ‘এতে করে দলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

২০১৪ সালে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির জেলা কমিটিতে ৪৫ শতাংশ নেতা ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার। সার্বক্ষণিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন নেতার সংখ্যা কমিটিতে মাত্র ২৩ শতাংশ।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে।  সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) এই সম্পাদক বলেন, ‘রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ বাকি আছে বলে মনে হয় না। ক্ষমতা ভোগ করা, ক্ষমতায় যাওয়া, ব্যবসায়িক স্বার্থ আরও সমুন্নত আর চরিতার্থ করার জন্যই রাজনীতি। নীতি-আদর্শ যেহেতু নেই, তাই এখন সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে।’

সুজন সম্পাদক এই প্রবণতাকে রাজনীতিতে অর্থ ও পেশীশক্তি ব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত করেন। তার ভাষ্য, ‘নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়ের বিষয়টিও ব্যবসায়ীরা আসছে বলেই হচ্ছে।’

রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা গুরুত্ব পাচ্ছেন না, ‘এর ফলাফল ভয়াবহ’ বলে মন্তব্য করেন এই পর্যবেক্ষক। তার কথায়, ‘দলের মধ্যে আন্তঃদল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পেছনেও এটাই মূল কারণ। এর রেশ ধরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের কোনও ধারণা নেই। তাই ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কারণ তারাই ক্ষমতায় আসে।’বাংলাট্রিবিউন থেকে নেওয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়