তারেক : সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের দ্বন্দ্বে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে সরকার। বিশেষ করে শামীম ওসমান সংঘর্ষের সময় ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে ঘটনাস্থলে যাওয়ার কথা বলায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাথে হকার বসা-না-বসা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষ। মেয়র আইভী হকার উচ্ছেদ করে শহরের ফুটপাথ উন্মূক্ত করছেন। আর সেই ফুটপাথেই হকার বসাতে চান শামীম ওসমান। তারা দুইজনই শাসকদল আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র ও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
অভিযোগ, মঙ্গলবার হকারদের মাঠে নামান শামীম ওসমান। আর তারাই আইভীর ওপর হামলা চালান। এমনকি শামীম ওসমানের সমর্থক বলে পরিচিত নিয়াজুল ইসলাম নামের এক যুবলীগ নেতা প্রকাশ্যে পিস্ত্মল বের করে মহড়াও দেন। আর তার সেই মহড়ার ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশও হয়েছে। ওই নেতা অবশ্য পরে গণপিটুনির শিকার হন। সংঘর্ষের সময় শামীম ওসমান নিজেই ঘটনাস্থলে ছিলেন এবং তাকে হ্যান্ড মাইকে কথা বলতেও দেখা যায়। শামীম ওসমান অবশ্য দাবি করেছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশেই তিনি সেখানে গিয়েছেন। সংঘর্ষে ১৫ জন সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হন। মেয়র আইভীও আহত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
শামীম ওসমানের ওই কথার জবাব দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'আমাকে যখন নারায়ণগঞ্জ পুলিশের এসপি ঘটনা জানান, তখন আমি দুইজনকেই (সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমান) ফোন করে বলেছি, অনভিপ্রেত ঘটনা স্টপ করতে। দুইপক্ষকেই ডাকব এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখব। আমি শামীম ওসমানকে ফোন করব কি মারামারি করতে? মারামারি বন্ধ করতেই আমি ফোন করেছি। এই প্র্যাকটিসটা বন্ধ করতে হবে। বুধবার সকালেও দুইজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করেছেন আইভী। তিনি হামলার উদ্দেশ্য ও কারণ ব্যখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, 'হকারদের ইসু্য করে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই হামলা করা হয়েছে। আমার নিকটাত্মীয়, ভাই, ভাগ্নে ও ভগ্নিপতিসহ কাছের নেতাকর্মীদের মুখ দেখে দেখে হামলা করা হয়েছে। ইটবৃষ্টি ঝরানো হয়েছে। আমি এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেব।'
আইভী বলেন, 'হকারদের উচ্ছেদ ঘটনাটি শান্ত্মিপূর্ণভাবে সমাধান করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা বিকল্প ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু, এরই মধ্যে ৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান অযাচিতভাবে হকার বসানোর ঘোষণা দিয়ে পরিবেশকে উত্তপ্ত করে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়েছে।'
জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'যখন আমার ওপর ইটবৃষ্টি ঝরানো হচ্ছিল, তখন পুলিশ কোথায় ছিল? এমন বিষয় ঘটতে পারে, সেটা জানিয়ে প্রশাসনের পক্ষশ থেকে আমাদের সাবধানও করা হয়নি।' বিকালে নারায়ণগঞ্জে আরেক সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান দাবি করেন, 'শামীম ওসমান বনাম আইভী নয়, সংঘর্ষ হয়েছে আইভী ও হকারদের মধ্যে। আমাকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফোন করে সেখানে যেতে বলেছেন। আমি না গেলে সেখানে অনেকের অস্ত্মিত্বই থাকত না। আমি যাওয়ার পর সেখানে কোনো ঘটনা ঘটেনি। একটা ইটও পড়েনি।'???????
তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী নিজে হকারদের আগে পুনর্বাসন করতে বলেছেন। এরপর উচ্ছেদ করতে বলেছেন। তাদের পুনর্বাসন না করে কেন উচ্ছেদ করা হচ্ছে?'
তিনি আরও দাবি করেন, 'আইভীর ওপর কোনো হামলা হয়নি। আইভী বিএনপির লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে হকারদের ওপর হামলা করে। শামীম ওসমান বলেন, 'আমি এখন গরিব মানুষের জন্য রাজনীতি করি এবং মৃতু্যর আগ পর্যন্ত্ম আমি তাদের জন্য রাজনীতি করে যাব।'
অস্ত্রধারী সম্পর্কে তিনি বলেন, 'নিয়াজুল আমাদের লোক, সে যুবলীগের কর্মী। তার ওপর হামলা হওয়ার পরই সে পিস্ত্মল বের করেছে।'
শাসকদলের মেয়র এবং সংসদ সদস্যের মধ্যে এ ঘটনায় সরকার বিব্রত। তাদের দুইজনকেই ডেকে পাঠানো হয়েছে ঢাকায়। আজ-কালের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের নিয়ে বৈঠক করবেন। তাদের নিয়ে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বসবেন বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে তিনি কয়েক দফা কথাও বলেছেন বলে জানা গেছে।
এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত্ম কমিটি গঠন করেছে। এ নিয়ে কোনো মামলা না হলেও পুলিশ দাবি করেছে, মঙ্গলবারের ঘটনায় কারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে, তারা সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
নারায়ণগঞ্জের এই পরিস্থিতিকে 'অশনিসংকেত' বলে অভিহিত করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, 'একজন আইন অনুযায়ী কাজ করতে গেছেন, আরেকজন হকারদের ফুটপাথে বসাতে গেছেন। আর এই সংঘর্ষে প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত।'
তিনি আরও বলেন, 'তারা দুইজনই শাসকদলের। কিন্তু যিনি ন্যায় করেছেন, তার ওপর হামলা করেছেন শাসকদলেরই আরেকজন। ন্যায়পরায়ণকে বাধা দিচ্ছে অন্যায়। এটা যদি দল না দেখে, তাহলে ভবিষ্যতে ভোটের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দলের এই কোন্দল দলের জন্য যেমন ক্ষতিকর, সাধারণ মানুষও এর শিকার হয়।
'অ্যাসিওরেন্স' দিচ্ছি কাউকে ছাড়ব না : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এদিকে নারায়ণগঞ্জে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির ওপর সশস্ত্র হামলা এবং এরপর আইভী ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় কাউকে ছাড় না দেয়ার 'অ্যাসিওরেন্স' দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। 'যারা অস্ত্র দেখিয়েছে, যারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছেন' তাদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্র ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীতকরণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সামনেই সংঘর্ষের ঘটনা এবং প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, 'দেখুন, একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য যা দরকার, সেটা আমরা করছি। যারা অস্ত্র দেখিয়েছে, যারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছেন, তাদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে। আমরা খতিয়ে দেখছি। ভিডিও ফুটেজ দেখে কারা করেছে তাদের ধরার জন্য প্রচেষ্টা নিচ্ছি এবং কি কারণে করল, এর পুরোপুরি একটা ইনকোয়ারি আমরা করছি।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, 'আমরা এটুকু অ্যাসিওরেন্স দিচ্ছি, আমরা কাউকে ছাড়ব না। যেই আইন ভঙ্গ করবে, তার ব্যবস্থা অবশ্যই হবে। জনপ্রতিনিধির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছি। তাদের বলেছি এ ধরনের কর্মকা- যদি বন্ধ না করেন তাহলে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এগুলো পছন্দ করছেন না। ব্যবস্থা নিতে হবে আমাদের।' যায়যায়দিন