শিরোনাম
◈ অবশেষে মার্কিন সিনেটে সাড়ে ৯ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ পাস ◈ কক্সবাজারে ঈদ স্পেশাল ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল চলাচল বন্ধ ◈ ইউক্রেনকে এবার ব্রিটেননের ৬১৭ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা ◈ থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ◈ জিবুতি উপকূলে অভিবাসীবাহী নৌকাডুবিতে ৩৩ জনের মৃত্যু ◈ লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, চাপ পড়ছে গ্রামে ◈ এফডিসিতে মারামারির ঘটনায় ডিপজল-মিশার দুঃখ প্রকাশ ◈ প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আয়ে ১৫.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ◈ প্রথম ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাত চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন নির্বাচিত ◈ বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ আহ্বান রাষ্ট্রপতির

প্রকাশিত : ১৩ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৯:৩৪ সকাল
আপডেট : ১৩ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৯:৩৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অপরাধ চাপা পড়ে ‘সমঝোতা’য়

ডেস্ক রিপোর্ট : ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। রাজধানীর মিরপুর থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় মাহফুজা আক্তার হ্যাপি নামের ১১ বছরের এক শিশুকে। তার একটি হাত ভাঙা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য নতুন ও পুরনো আঘাতের চিহ্ন ছিল। শিশুটিকে মিরপুর মডেল থানায় নেওয়ার পর জানা যায়, সে জাতীয় ক্রিকেট দলের পেস বোলার শাহাদাত হোসেনের গৃহকর্মী। শাহাদাত হোসেন এবং তার স্ত্রী জেসমিন জাহান নিত্যর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শিশুটি বাসা থেকে পালিয়েছে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় শাহাদাত দম্পতিকে খালাস দেন আদালত। অভিযোগ রয়েছে, বিচার চলাকালে আসামিপক্ষের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিল বাদীপক্ষ।

দু'মুঠো খাবারের আশায় মা, ভাই-বোন, নিজ পরিবার ছেড়ে গৃহকর্মী হয়ে ঢাকায় এসেছিল আট বছরের শিশু আদুরি। কিন্তু খাবারের পরিবর্তে শিশুটির ভাগ্যে জুটেছিল নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের একপর্যায়ে ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আদুরি অচেতন হয়ে পড়লে গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী তাকে মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার একটি ডাস্টবিন থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গৃহকর্ত্রী নদীকে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন দিয়েছেন আদালত। রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন নির্যাতিতা আদুরি, তার মাসহ পরিবারের সদস্য এবং মামলা পরিচালনায় সহায়তাকারী আইনজীবীরা।

একজন আদুরিকে নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধীর শাস্তি হলেও হ্যাপির মতো অসংখ্য শিশু রয়েছে, যাদের ওপর নির্যাতনকারীরা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। এমনকি নির্যাতনে মারা গেলেও নূ্যনতম শাস্তি হয় না ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের। নির্যাতনের শিকার হয়ে আহত-নিহতের পরিবারের আর্থিক ক্ষমতা না থাকার কারণে তারা শেষ পর্যন্ত সমঝোতা করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকলেও নানা কারণে মামলা চালাতে পারেন না।

শিশু গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাকে অমানবিক বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। এ ধরনের নিষ্ঠুরতা পরিহার করতে তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানান। গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের খবর পাওয়া গেলেই তা স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর জন্য আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সন্ধান পেলে সেটাও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কিংবা জেলা প্রশাসকদের জানানোর অনুরোধ জানান। পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে চালু হওয়া হটলাইন নম্বর ১০৯-এ জানানোর জন্যও তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট শিশু শ্রমিক ৩২ লাখ। তাদের মধ্যে চার লাখ ২০ হাজার শিশু গৃহকর্মে নিয়োজিত। আর গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই কন্যাশিশু। 'গোপন দাসত্ব :শিশু গৃহশ্রমিক' শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহকর্মে নিয়োজিত ৫৪ শতাংশ শিশু নানাভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় ৫৭ শতাংশ শিশু গৃহকর্মী। গ্লোবাল মার্চ, এডুকো, মানুষের জন্য, শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ), তেরে দেশ হোমস ও ওয়ার্ল্ড ভিশনের যৌথ উদ্যোগে করা সর্বশেষ এ গবেষণা ২০১৫ সালের শেষদিকে প্রকাশ করা হয়েছিল। আর ওই বছরই প্রকাশিত দ্য নিলসেন কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড পরিচালিত পৃথক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গৃহকর্মে নিয়োজিত ৬৬ শতাংশ শিশু মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। ধর্ষণের শিকার হয় ৭ শতাংশ।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত ১০ বছরে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচ সহস্রাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি হয়েছে- উল্লেখ করার মতো এমন সংখ্যা নেই। সংস্থাটি নির্যাতিতদের পক্ষে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিও বলছে, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্তরা সাজা পায় না বললেই চলে। সমিতির হিসাবে, ২০১৫ সালে ৪৮ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের ১৫ জনকে হত্যা ও ১৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরের বছর ২০১৬ সালে ৭৫ গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে, যাদের ১৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ছয়জন আত্মহত্যা করেছে।

আর সদ্য বিদায়ী ২০১৭ সালে ৬৮ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার, যাদের মধ্যে ১২ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং আত্মহত্যা করে পাঁচজন। সমিতি বলছে, গত বছরসহ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় অর্ধেকেরও কম মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনার অধিকাংশই সমঝোতায় শেষ হয়ে যায়। যে দু-একটি মামলা হয়, সেটারও বেশির ভাগ বিচার পর্যন্ত গড়ায় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আদুরির ওপর নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত

গৃহকর্ত্রীর যাবজ্জীবন সাজা এক ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে আর কোনো মামলা মাঝপথে থেমে যাবে না।

গৃহকর্মী নিবন্ধন অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী, প্রত্যেক গৃহশ্রমিককে নিয়োগের ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্নিষ্ট থানায় গিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। তবে এর বাস্তব কোনো প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনের চলমান অ্যাডভোকেসি কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০১৫ সালে গৃহকর্মীদের জন্য 'গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা' অনুমোদন দিয়েছে। গত দুই বছরেও এ নীতিমালার বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ দৃশ্যমান হয়নি। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় 'গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা'র যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন জরুরি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচার পর্যন্ত যেতে পারে না। তার আগেই দু'পক্ষ সমঝোতা করে ফেলে এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এ ধরনের মামলায় বাদীপক্ষ দুর্বল, দরিদ্র থাকে। তারা আর্থিক অনটনের কারণে মামলা চালাতে পারে না। এ সুযোগ নেয় আসামিপক্ষ। আমরা চাই, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হোক। কোনো ফাঁকফোকরেই যেন তারা শাস্তির আওতা থেকে বের হতে না পারে। সমকাল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়