মোহাম্মদ আবু নোমান : স্বাধীনতার পর পিছনে ফেলে এসেছি প্রায় ৫ দশক সময়। দেখতে দেখতে কৈশোর, যৌবন, পূর্ণবয়স্ক, প্রৌঢ়ত্বকালেরও শেষ মার্জিনের পর বার্ধক্যই কেবল বাকি। এ পর্যায়ে এসে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষা খুবই প্রাসঙ্গিক। কি পাওয়ার কথা ছিল, আর কি পেলাম? আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন এই স্বাধীনতা। পৃথিবীর অনেক দেশেরই বিজয় দিবস নেই। আমরা একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের উত্তরাধিকারী। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছর মোটেই কম সময় নয়। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির খতিয়ান সন্তোষজনক কি? ভুললে চলবে না, লাখো মা-বাবা, ভাই-বোনের রক্তে কেনা এই বাংলাদেশ।
এত দুঃখ, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতা নিয়ে এত কামড়াকামড়ি, তারপরও বুক ফুলিয়ে, উঁচিয়ে, বলব- হয়ত আমার প্রিয় দেশটা স্বাধীন। কিন্তু আমরা...? আমাদের ব্যক্তি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জিত কি হয়েছে? নাকি একদল শোষকের স্থান নিয়েছে আরেকদল শোষক, আর আমরা হয়েছি অবোধ, নির্বোধ, গবা দর্শক! দীর্ঘ সময়ের পরও আমাদের ব্যর্থতার বোঝা পাহাড়সম। একাত্তরে যুদ্ধ করেছিলাম অন্য দেশের অত্যাচারিতদের বিপক্ষে। এখন যুদ্ধ করতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আমাদের স্বাধীনতা কি ছাগলের রশি কশাইয়ের হাত বদলের মতোই কি?
আমরাতো বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। নিজের মতো করে কথা বলতে চাই।
আমরা চাই- ঘুষ ছাড়াই চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতামাফিক ভর্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ, নৈতিকতাধর্মী শিক্ষাব্যবস্থা, সুন্দর-সুখী বাংলাদেশ, দুর্নীতি ও ক্ষুধামুক্ত দেশ। যেখানে টাকার বিচারে নয়, মেধার বিচারে চাকরি হবে। বিজয়ের ৪৭ বছরে প্রকৃত অর্থে আমরা কী দেখছিÑ অপহরণ, খুন, গুম, গণধর্ষণ, ছিনতাই, অশ্লীলতা, দুর্নীতি, আধুনিকায়নের নামে নোংরা অপসংস্কৃতি, সর্বত্র মাদকদ্রব্যের আগ্রাসন, শিক্ষার নামে কোচিং বাণিজ্যসহ বহুমুখী সমস্যায় দেশ। এসব কি আমাদের মেরুদ- ভাঙার ষড়যন্ত্র নয়কি? তাহলে স্বাধীনতার সুফল আমরা পেয়েছি কি? সাধারণ মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। হানাহানি, রক্তপাত, ঘুষ, দুর্নীতি, মেধাবীদের অবমূল্যায়ন এখন সমাজে বাসা বেঁধেছে। আমরাতো এমন দেশ চাই, যেখানে থাকবে না- রাজনৈতিক হানাহানি, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতি।
বিজয়ের ৪৬ বছরে এখনো মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করাসহ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে এমন বিশ্বাসও নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন আমাদের আত্মমর্যাদার জায়গা। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য অর্থ লেনদেন এখন প্রকাশ্য বিষয়। ইতোপূর্বে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হওয়ায় ৬ সচিবসহ ৩ হাজার ব্যক্তির নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ার ঘটনাটিও দেশজুড়ে বেশ আলোচিত হয়েছে। টাকায় এদেশে সবকিছু সম্ভব! তাহলে নয় কেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ? একটা জাতির মুক্তি সংগ্রামের স্বীকৃতি নিয়ে যখন রাজনৈতিক ও বাজারি পণ্যের মতো চেতনা ব্যবসা জমজমাট হয় তখন সে দেশের সর্বক্ষেত্রে নষ্টের জোয়ার ছাড়া আর কি আশা করা যায়। বীরের বীরত্ব বিক্রিযোগ্য পণ্য নয়। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধারা আজ বঞ্চিত ও কোণঠাসা হয়ে গেছে এই ভুয়াদের ভিড়ে।
সব সীমাবদ্ধতা ঠেলে, মাড়িয়ে, ডিঙিয়ে বিজয়ের ৪৭ বছর পদার্পণে বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে হবেই। তা না হলে বাঙালির সব আন্দোলন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও আত্মবিসর্জন বৃথা হয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
আপনার মতামত লিখুন :