ডেস্ক রিপোর্ট : শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ২৬ বছরের যুবক আনোয়ার হোসেন। একসময় নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করতেন। পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে নিয়োগ পান মন্ত্রণালয় পরিচালিত শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট (মৈত্রী শিল্প) পরিচালিত ওয়াটার প্লান্টে। ১০ বছর ধরে এখানে কর্মরত তিনি। এখন কাজ করছেন সুপারভাইজার হিসেবে। পারিপার্শ্বিকতা ও প্রতিবন্ধকতার কাছে হার না মানা এ যুবক নিজেকে কেবল স্বাবলম্বীই করেনি, হয়ে উঠেছেন পরিবারের আয়ের প্রধান জোগানদাতাও। তার ভাষায়, শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট তার ভাগ্য গড়ে দিয়েছে। অন্যথায় সমাজের চোরাগলিতে হারিয়ে যেতেন তিনি।
বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী রুমানা আলমও একসময় নিজেকে পরিবারের বোঝা ভাবতেন। আজ তিনি পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। মৈত্রী শিল্পে কর্মরত রয়েছেন ছয় বছর ধরে। একই প্রতিষ্ঠানে অনেক বছর ধরে কাজ করছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী আসাদুজ্জামান। তার জীবনের গল্পটিও একই রকম।
আনোয়ার হোসেন, রুমানা আলম ও আসাদুজ্জামানের মতোই মৈত্রী শিল্পের কর্মীদের প্রত্যেকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট। এদের সবাই প্রতিবন্ধী। সমাজের অবহেলিত এসব শারীরিক প্রতিবন্ধীকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মক্ষম করে তোলার পাশাপাশি কাজের সুযোগ করে দিয়েছে ট্রাস্টটি। সবচেয়ে ভালো খবর হলো, প্রতিবন্ধীদের পরিচালিত ট্রাস্টটি এখন মুনাফায় চলছে। চলতি বছরও এ ধারা বজায় থাকবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের মৈত্রী শিল্পে প্রক্রিয়াজাতকৃত মুক্তা পানি ব্যবহার করেন। তার দপ্তর ও বাসভবনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও এ পানি ব্যবহার হয়। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরেও এখন এ পানি ব্যবহার হচ্ছে। এর আগে বিভিন্ন ধাপে গুণগত মান পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উতরে গেছে প্রতিষ্ঠানটির পানি।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অধিকারের সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শারীরিক প্রতিবন্ধী কর্মীদের শ্রম ও মেধা কাজে লাগিয়ে এবং আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা রিভার অসমোসিস পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ট্রাস্টটি। জানা গেছে, প্রতিবন্ধীদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার লক্ষ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের (মৈত্রী শিল্প) উদ্যোগ হাতে নেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ট্রাস্টের কর্মীদের প্রক্রিয়াজাত মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার বাজারে নয়টি ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির বোতল ও জারে (৫০ মিলিলিটার, ৩০০, ৫০০, ৬০০, ১০০০, ১৫০০ ও ২০০০ মিলিলিটারের বোতল এবং ৫ ও ২০ লিটারের জার) পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া এখানকার প্লাস্টিক কারখানায় জগ, মগ, বালতি ও গামলাসহ মোট ৭০ ধরনের পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।
ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সির (সিডা) যৌথ আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় মৈত্রী শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। দুই দেশের বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবেই ‘মৈত্রী শিল্প’ নামে পরিচিতি লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে মৈত্রী শিল্প। প্রতিষ্ঠাকালে এতে মোট ৪ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে সিডা ও বাংলাদেশ সরকার। এর পর ১৯৯৭-০৪ মেয়াদে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মোট ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য শিল্প উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন’ শীর্ষক এক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
২০০৭-০৮ অর্থবছরে এসে প্রতিষ্ঠানটি রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়। পরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি অধীনে এনে মৈত্রী শিল্প ট্রাস্টি বোর্ডের পুনর্গঠন হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারের আর্থিক সহায়তায় আগের সব বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি মৈত্রী শিল্পের বোতলজাত পানির বোতলগুলো আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন করার লক্ষ্যে নতুন করে ডিজাইন ও মোল্ড তৈরি করা হয়েছে। মেরামত ও প্রতিস্থাপন করে সচল করা হয়েছে অচল যন্ত্রপাতি। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকেই লাভজনক হয়ে ওঠে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকারও বেশি মুনাফা অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। এ বছরও প্রতিষ্ঠানটির লাভজনক ধারা অব্যাহত থাকবে এবং তা গত অর্থবছরের মুনাফাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, চলতি বছর মৈত্রী শিল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩০০ শারীরিক প্রতিবন্ধীর জীবনমান উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আয় বাড়ানোর লক্ষ্যেও বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সাতটি বিভাগীয় শহরে মৈত্রী শিল্পের শাখা অফিস ও বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজও চলছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট, মৈত্রী শিল্পের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে লাভজনক অবস্থায় আছে। আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করি। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে টিমওয়ার্ক করি। প্রতিবন্ধীরা যে কাজ করতে পারে, আন্তরিক হলে তাদেরও এগিয়ে নেয়া যায়; তা আমরা প্রমাণ করেছি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও আমাদের প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পানির ভোক্তা। এছাড়া তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের উৎপাদিত মুক্তা পানির বোতলের প্রশংসা করেছেন। এসবে আমরা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত। মুক্তা পানিকে এগিয়ে নিতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। আট বিভাগে মুক্তা পানির শোরুম কাম সেলস সেন্টার করার উদ্যোগ বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ ও খুলনায় মুক্তা পানির বিক্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিবন্ধীসহ সমাজের সব স্তরের ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। চলতি অর্থবছরই মৈত্রী শিল্পকে একটি টেকসই প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা।
সূত্র : বণিক বার্তা
আপনার মতামত লিখুন :