শিরোনাম
◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো ◈ রেকর্ড বন্যায় প্লাবিত দুবাই, ওমানে ১৮ জনের প্রাণহানি

প্রকাশিত : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৯:২০ সকাল
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৯:২০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

গৌরনদীতে বিজয় পতাকা উড়েছিল আজ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় ঘোষিত হলেও বরিশালের গৌরনদী পাকহানাদার মুক্ত হয়েছিলো ২২ডিসেম্বর। বাংলাদেশের মধ্যে সর্বশেষ বিজয় পতাকা উড়েছিলো গৌরনদীতে। টানা ২৮দিন মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যৌথ আক্রমণের পর ওইদিন গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে অবস্থানরত শতাধিক পাকসেনা মিত্র বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করেছিল। হানাদার বাহিনী অত্র এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাঁচ সহস্রাধিক নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা ও তিন শতাধিক মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে।

ওই বছরের ২৫ এপ্রিল হানাদাররা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে এ জনপদে প্রবেশের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের প্রবেশের খবর শুনে স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা গৌরনদীর সাউদের খালপাড় নামকস্থানে তাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নেয়। হানাদাররা সেখানে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। হানাদারদের সাথে সেইদিন সম্মুখ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন নাঠৈরের সৈয়দ হাসেম আলী, চাঁদশীর পরিমল মন্ডল, গৈলার আলাউদ্দিন ওরফে আলা বক্স ও বাটাজোরের মোক্তার হোসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ওইদিন আটজন পাক সেনা নিহত হয়। এটাই ছিল বরিশালে স্থলপথে প্রথম যুদ্ধ এবং এরাই প্রথম শহীদ। বরিশালে প্রবেশদ্বারের মুখে পাক হানাদাররা গৌরনদীর খাঞ্জাপুরে মোস্তান নামের এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করেছিল।

সেইদিনের প্রত্যক্ষদর্শী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু জানান, ওইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হবার পর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। তাদের গুলিতে ওইদিন দুই শতাধিক লোক মারা যায়। হানাদাররা গৌরনদী বন্দরসহ শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পে ছিল আড়াই শতাধিক সৈন্য ও ৫০ জনের মতো রাজাকার, আলবদর। বাটাজোর, ভুরঘাটা, মাহিলাড়া, আশোকাঠী, কসবাসহ প্রতিটি ব্রীজে পাক মিলিটারীদের বাংকার ছিলো। উত্তরে ভুরঘাটা, দক্ষিণে উজিরপুরের শিকারপুর, পশ্চিমে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট, পূর্বে মুলাদী পর্যন্ত গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পের পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। এদের দোসর ছিলো এলাকার রাজাকার, আলবদর ও পিস কমিটির সদস্যরা। হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, নারী ধর্ষণসহ নানা কাজে এরা হানাদারদের সহযোগিতা করতো।

সূত্রমতে, পাক সেনারা গৌরনদী কলেজের উত্তর পার্শ্বে একটি কূপ তৈরি করে সেখানে লাশ ফেলতো। কলেজের উত্তর পার্শ্বে হাতেম পিয়নের বাড়ির খালপাড়ের ঘাটলায় মানুষ জবাই করে খালের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। গার্লস হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী পুল ও গয়নাঘাটা ব্রীজের ওপর বসে মানুষ হত্যা করে খালে লাশ ফেলতো পাক সেনারা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননায় আরও জানা গেছে, শত শত লোক ধরে এনে ওইসবস্থানে হত্যা করা হয়েছে।

গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৯৭১ সালের ১৫ মে। ১৪ মে দোনারকান্দিতে চিত্ত বল্লভের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ঢাল শুড়কী নিয়ে পাক হানাদারদের মুখোমুখি ঝাঁপিয়ে পরে চারজন পাক সেনাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়। কসবার হযরত মল্লিক দুধ কুমার পীর সাহেবের মাজার সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চাঁদশী হয়ে পশ্চিম দিকে শতাধিক সেনা অগ্রসর হয়ে জনতার ওপর এলএমজির ব্রাশ মারে এবং গুলি করে পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। পাক সেনাদের ভয়ে সেদিন আশেপাশের সাত থেকে আটটি গ্রামের ৪-৫ হাজার মানুষ এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। রাংতার উত্তর পাশের ক্যাতনার বিলে ধান ও পাট ক্ষেতের মধ্যে আশ্রয় নিতে এসে পাক বাহিনীর গুলিতে ওইদিন পাঁচ শতাধিক লোক প্রাণ হারায়। নরপশুদের কবল থেকে সেদিন পশুরাও রেহাই পায়নি। শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ফলে ওইদিন বহু গরু-ছাগল ও হাঁস মুরগী মারা যায়। ২ আষাঢ় কোদালধোয়া নামকস্থানে দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাসের মালিক লক্ষণ দাস ও তার একটি পোষা হাতিকে পাকসেনারা এক সাথে গুলি করে হত্যা করে। জুলাই মাসে বাটাজোরে নিজাম বাহিনীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ১০জন পাকসেনা মারা যায় এবং চারজন জীবিত ধরা পরে। পাকসেনাদের গতিরোধ করার জন্য ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের আশোকাঠী বাসষ্ট্যান্ডের ব্রীজ মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙ্গে দিয়েছিল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে।

মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে ব্রিজটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এর কয়েকদিন পর নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে হোসনাবাদে পাকবাহিনীর অস্ত্র ও মালবাহী বোটে হামলা চালিয়ে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনীরা। ওইদিন যুদ্ধে প্রায় ২৫জন পাকসেনা মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজাম উদ্দিনের সাথে অংশ গ্রহণকারী অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন গ্রুপ কমান্ডার বাদশা হাওলাদার, কুতুব উদ্দিন, তাহের কমান্ডার, হামেদ কমান্ডার ও আলাউদ্দিন মিয়া।

গৌরনদীর কসবা এলাকার আল্লাহর মসজিদের কাছে ২৭ নভেম্বর পাক বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে মোঃ ছাত্তার কমান্ডার গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। পরেরদিন একইস্থানে দক্ষিণ চাঁদশীর আলতাফ হোসেন শহীদ হন। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া এলাকার কৃষক শ্রমিক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (সাবেক মন্ত্রী), আব্দুল করিম সরদার (সাবেক এমএলএ) সর্বপ্রথম স্বেচ্ছাসেবক দল গঠণ করেন। ওইদলের প্রধান ছিলেন গৈলার মতি তালুকদার, তার সহযোগী ছিলেন পতিহারের নুরু গোমস্তা।

কোটালীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। তিনি সর্বপ্রথম অত্র অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার নেতৃত্বে আগৈলঝাড়ার শিকির বাজার, রামশীল ও পয়সারহাটে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে গৌরনদীর হোসনাবাদ গ্রামের নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে ৬০ থেকে ৭০ জন মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় আসেন। নিজাম উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।

সর্বশেষে মুজিব বাহিনীর একটি দল ভারত থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ (বর্তমানে বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য), তার চাচাত ভাই রকিব সেরনিয়াবাত, কসবার ফজলুর রহমান হাওলাদার, বিল্বগ্রামের মেজর শাহ আলম তালুকদার ছিলেন তার সহযোগী।

গৌরনদী কলেজে নিজাম বাহিনী ও মুজিব বাহনীর যৌথ প্রচেষ্টায় আক্রমণ চালানো হয়েছিল। পশ্চিম দিক থেকে মুজিব বাহিনী ও পূর্বদিক থেকে নিজাম বাহিনী আক্রমণ করে। টানা ২৮দিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা পরাস্থ হয়ে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর মেজর ডিসি দাসের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বশেষ হানাদার মুক্ত গৌরনদীতে ১৯৭৫ সালের ৭মে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন। দীর্ঘ বছর পেরিয়ে গেলেও গৌরনদীতে আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনদীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে দ্রুত স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

দিবসটি পালন উপলক্ষে অদ্যবধি সরকারি উদ্যোগে কোন কর্মসূচী পালন করা না হলেও প্রতিবছরের ন্যায় এবারও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের উদ্যোগে র‌্যালী, আলোচনা সভা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া-মিলাদ ও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়