শিরোনাম

প্রকাশিত : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১০:৩৬ দুপুর
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১০:৩৬ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রতিশ্রুতিতে গণ্ডিবদ্ধ বস্তি উন্নয়ন

ডেস্ক রিপোর্ট : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের গুলশান ও বনানী এলাকায় গত কয়েক বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও আঁধারেই রয়ে গেছে ঢাকার সবচেয়ে বড় কড়াইল বস্তি। অথচ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই বস্তির ভোটাররা। কিন্তু ভোট ছাড়া এসব বস্তির মানুষদের আর কোনো গুরুত্ব নেই কারো কাছেই। শুধু এই কড়াইল বস্তিই নয়, গেল ১১ বছরে রাজধানীর ছোট-বড় ২৪১টি বস্তিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি।

কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার হিসাবে ঢাকার বস্তিগুলোতে অন্তত ৪০ লাখ দরিদ্র মানুষ বাস করছেন। এর মধ্যে ১৭০ একর আয়তনের কড়াইল বস্তিতে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষের বসবাস। তবে অনেকের ধারণা, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। নাগরিক জীবনের প্রায় সকল সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত এসব মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে আলাদা দুটি বিভাগও রয়েছে। একজন করে 'বস্তি উন্নয়ন' কর্মকর্তাসহ আরও বেশকিছু জনবল আছে সংস্থা দুটির। সরকারি-বেসরকরি বিভিন্ন সংস্থা যুগ যুগ ধরে প্রকল্পের পর প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও বস্তিবাসির জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বলছে, তাদের নিজ নিজ এলাকার বস্তিবাসির জীবনমান উন্নয়নে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাজে সহযোগিতা করা ছাড়া বর্তমানে আর কোনো কাজ নেই সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন বিভাগ দুটির। এসব এনজিওগুলোর বেশিরভাগই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে বেশি ব্যস্ত। তাই শহরের প্রায় ৪০ লাখ বস্ত্মি বস্তিবাসির জীবনমান উন্নয়নে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার অনুদানের ওপর নির্ভরশীল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বস্তি উন্নয়ন বিভাগটিতে দীর্ঘ ১১ বছরে কোনো উন্নয়ন কাজ নেই। এর ফলে একরকম অলস সময় পার করছেন ওই বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বেশিরভাগ সময় গল্প-গুজব করে সময় পার করছেন তারা।

২০০১ সালে ইউএনডিপি ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় সিটি করপোরেশন বস্তি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। ২০০৬ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এরপর থেকে শাখাটিতে তেমন কোনো কাজ নেই। ডিএসসিসিতে 'বস্তি উন্নয়ন' শাখায় একজন উপ-সচিব মর্যাদার কর্মকর্তা ও দুইজন অফিস সহায়ক রয়েছেন। কাজ না থাকায় অফিস সহায়ক দু’জনই খোশগল্প করে সময় কাটাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে এক অফিস সহকারী গল্পের ফাঁকে এ প্রতিবেদককে জানান, প্রকল্প চলাকালীন ব্যস্ত সময় পার করলেও বর্তমানে অফিসে তেমন কোনো কাজ নেই। অফিসে কাজ না থাকায় এখন বেকার থাকার মতোই মনে হচ্ছে তার কাছে।

ডিএনসিসি সূত্র জানিয়েছে, গত চার-পাঁচ বছরে তাদের এলাকার অন্তত ৬০টি বস্তিতে প্রায় ৩৩ কোটি টাকার উন্নয়ন করা হয়েছে। এসব উন্নয়নের মধ্যে রাস্তা-ঘাট, টয়লেট, বাচ্চাদের ডে-কেয়ারসহ নানা কর্মকাণ্ড রয়েছে। কিন্তু সরেজমিন ঘুরে এসব উন্নয়নের তেমন সুফল চোখে পড়েনি।

রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশন সংলগ্ন বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, খাওয়া ও গোসলের পানি, টয়লেট সমস্যা খুব প্রকট। পুরুষ বাসিন্দারা মসজিদ ও মার্কেটে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারলেও বিপদে পড়েন বয়সী নারীরা। দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া না দিতে পারায় অস্বস্তির পাশাপাশি নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। এসব সমস্যা আরও প্রকট রাজধানীর সবচেয়ে জনবহুল কড়াইল বস্তিতে।

কড়াইল বস্তিতে গত চার-পাঁচ বছরে উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে বস্তির বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কিসের উন্নয়ন, কই উন্নয়ন? লাইন ধরে গোসল করতে হয়, দূষিত পানি খেতে হয়। নেই টয়লেট। ৩ হাজার মানুষের জন্য একটি পানির লাইন। সেখানে রাত জেগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। বস্তিবাসির কথা কোনো সরকারই ভাবে না। শুধু ভোট আসলেই সবাই এসে মাথায় হাত বুলায় আর রাতের বেলায় নোট (টাকা) ধরিয়ে দিয়ে যায় বলে জানান তিনি। এছাড়া রায়েরবাজার, কল্যাণপুর, হাজারীবাগ, আগারগাঁও, কামরাঙ্গীরচরসহ প্রায় সব বস্তির বাসিন্দারাও এসব সমস্যায় জর্জরিত বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিএনসিসির বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ডিএফআইডির অর্থায়নে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গত তিন-চার বছরে প্রায় ৬০টি বস্তিতে উন্নয়ন কাজ করেছেন তারা। বর্তমানে বস্তি নিয়ে কাজ করছে এমন এনজিওগুলোর কাজ মনিটরিং করছেন। তিন মাস অন্তর অন্তর তাদের কাজ পর্যালোচনা ও সমন্বয় করতে মিটিংও করছেন।

ডিএনসিসির প্রধান বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা এ. কে. এম লুৎফুর রহমান সিদ্দিক জানান, কয়েক বছর আগে ইউএনডিপি ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় বস্তিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও এখন আর তা নেই। তবে ২০১৮ সালে বস্তি উন্নয়নে একটি প্রকল্প নেয়া হবে। কাজ না থাকায় একজন অফিসার কমানো হয়েছে। কিছুদিন আগেও যেসব এনজিও বস্তি উন্নয়নে আগ্রহ দেখাত, তারা এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যস্ত।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, বস্তির উন্নয়ন আটকে থাকায় চরম দুর্ভোগ ও কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন শহরের বিভিন্ন বস্তির বাসিন্দারা। তবে সরকার বিভিন্ন জায়গায় তাদের আবাসনের চেষ্টা চালাচ্ছে। সেভাবে পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে।

তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বস্তিবাসিদের জীবনমানের কোনো পরিবর্তন না হলে সরকারি অর্থ অপচয় করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে অফিস ভরে রাখলে কি লাভ হবে? সেনিটেশন, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ কোনো নাগরিক সুবিধা পান না বস্তির মানুষ। বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো বস্তিবাসির জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে, তারও সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অথচ ভোটের সময় আসলে এসব বস্তিবাসির সমর্থন পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন সব দলের প্রার্থীরা। এমন মানসিকতা পরিহার করে বস্তিবাসীর উন্নয়নে সরকারকে আন্তরিক হতে পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই।

প্রসঙ্গত, রাজধানীর রায়েরবাজার, কল্যাণপুর, হাজারীবাগ, আগারগাঁও, কামরাঙ্গীরচর কড়াইলসহ কয়েকটি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের পর বসতি কিছুটা কমলেও অন্যান্য বস্তিতে প্রতিনিয়তই জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। ন্যূনতম কোনো নাগরিক সুবিধা না থাকলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ আসছে এসব বস্তিতে। নদী ভাঙন, বন্যা, খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের শেষ ঠিকানা এসব বস্তি। রাজধানীর সরকারি জায়গায় ছোট-বড় মোট ২৪১টি বস্তি রয়েছে। এর মধ্যে রেলওয়ের জায়গায় গড়ে উঠেছে অন্তত ৭০টি বস্তি। অন্য বস্তিগুলো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জায়গায়।

সূত্র : যায়যায়দিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়