ড. শরীফ এনামুল কবির : শিক্ষক সমাজ একটি দেশের সামগ্রিক অবকাঠামো গঠনের প্রধান হাতিয়ার। সুশিক্ষা একটি জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। সমাজে আলোকিত মানুষ গঠনে একজন শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। আর আলোকিত মানুষ তৈরি করার মাধ্যমেই কেবল গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন সম্ভব। শিক্ষকরা দেশের ভবিষ্যত্ নাগরিক তৈরি করেন। একজন শিক্ষকই তৈরি করতে পারেন একজন ভালো বিচারক, প্রশাসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ। এ কারণে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটা উদাহরণ দেয়া যাক— লক্ষ্মীপুরের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিতে দুই শিফটে মোট এক হাজার ১৭০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর পাঠদানের জন্য বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক রয়েছেন ৩০ জন। এর মধ্যে একজন শিক্ষক বর্তমানে প্রশিক্ষণে রয়েছেন। সে হিসাবে বিদ্যালয়টিতে প্রতি ৪০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক মাত্র একজন। এতে দুই শিফটের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের। ফলে ব্যাহত হচ্ছে মানসম্মত পাঠদান। আদর্শ সামাদ উচ্চ বিদ্যালয়ই শুধু নয়, একই অবস্থা মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকের অনুপাতে সবচেয়ে শিক্ষার্থী বেশি বাংলাদেশে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতের তুলনামূলক চিত্র উঠে এসেছে ব্যানবেইসের গেল বছরের রিপোর্টে। গতবছরের নভেম্বরে দেশের নয়টি শিক্ষা প্রশাসনিক অঞ্চলের ছয় হাজার ৫৯৪টি বিদ্যালয় ঘুরে এ প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যানবেইস। প্রতিবেদনটি বলছে, বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় প্রতি একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৫ জন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতে এ অনুপাত ৩১, নেপালে ২৯, পাকিস্তানে ১৯ ও শ্রীলংকায় ১৭। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। দেশটিতে প্রতি একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ১৪ জন। মাধ্যমিক শিক্ষায় যতটুকু উন্নয়ন প্রয়োজন ছিল, ততটা করা সম্ভব হয়নি। দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। এসব বিদ্যালয় আর্থিক সংকটের কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। তবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকটসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যালয়গুলোকে নানা সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন, গ্রহণযোগ্য ও সময়োপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই দক্ষ শিক্ষক। এক্ষেত্রে শিক্ষকের দক্ষতা ও যোগ্যতার পাশাপাশি পেশার প্রতি আন্তরিকতা এবং অন্য আনুষঙ্গিকতাও রয়েছে, যেগুলো বেশ জরুরি।
প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার নিয়ন্ত্রণে আসার ফলে গেল কয়েক বছরে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তবে শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টি ও শূন্যপদে নিয়োগ না দেয়ায় শিক্ষার্থীর অনুপাতে বাড়ছে না শিক্ষক সংখ্যা। ফলে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। এর সত্যতা মিলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যেও। মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৩৩টি। এসব বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের ১০ হাজার ছয়টি পদের মধ্যে এক হাজার ৭৪৪টিই শূন্য। প্রধান শিক্ষকের ৩২৪টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৮৪টি। আর নয়টি বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষকের পদই। সহকারী প্রধান শিক্ষকের ৪৫৭টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৩৬৭টি। সবচেয়ে বেশি শূন্যপদ বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে। এদিকে মাধ্যমিক শিক্ষায় পাঠদানরত শিক্ষকদের অনেকেই অপ্রশিক্ষিত। মাউশির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৪১ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে না। এর মধ্যে ২৩ দশমিক ৭২ শতাংশ বিদ্যালয় শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরিতে অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তা নেয়। আর ১৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ বিদ্যালয় বাইরে থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে থাকে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালুর সাত বছর পরও এমন চিত্র শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য হুমকি। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হলে বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশ্ন প্রণয়নের সামর্থ্য তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩৫ শতাংশ বিদ্যালয়েই কম্পিউটার শিক্ষক নেই। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয়গুলোর চিত্র সবচেয়ে হতাশাজনক। সরকারি অর্থে পরিচালিত ৮৫ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই কোনো কম্পিউটার শিক্ষক নেই। আর দেশে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ৩৪ শতাংশে কম্পিউটার শিক্ষক নেই। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বিদ্যালয়ে কম্পিউটার সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয়ে এ হার প্রায় শতভাগ। তবে এসব কম্পিউটারের ৭৩ শতাংশ একাডেমিক ও দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার হয়। অন্যান্য সুবিধার মধ্যে মাল্টিমিডিয়া সুবিধা রয়েছে ৮০ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। আর ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে ৮০ শতাংশ বিদ্যালয়ে। এটা নিঃসন্দেহে আশার কথা বলে না। এ থেকে অন্তত অনুমান করা যাচ্ছে, মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে যে উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত ছিল, তা নিশ্চিত করা আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে সরকারি খাতের পাশাপাশি দেশের অনেক মাধ্যমিক স্কুল পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে। সেখানে অর্থাভাব থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপকদের অনীহা হেতু প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করার ফলে এ খাতে ঝরেপড়া রোধসহ অনেক ফলপ্রসূ পরিবর্তন এসেছে। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা। আর্থিক সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সরকারের উচিত, উপজেলাভিত্তিক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা। সম্প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এখন যে পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রাথমিকের গ্লি পেরিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা লাভের আশায় আসছে, তা আগের তুলনায় ঢের বেশি। কিন্তু সে অনুপাতে শিক্ষকের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষকরা সে মেরুদণ্ডের স্রষ্টা। পিতামাতা কেবল সন্তানের জন্ম দিতে পারে কিন্তু সে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ করা, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে দায়িত্ববোধ ও সচেতন করে সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পৃথিবীতে যতগুলো সম্মানজনক পেশা আছে তার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা। অথচ প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন নিয়ে যে দ্বন্দ্ব চলছে, তা আজো নিরসন হয়নি। বেসরকারি স্কুলশিক্ষকদের একটি অংশ বছরের পর বছর ধরে ঢাকায় প্রেসক্লাবের সামনে মিটিং, মিছিল ও মানববন্ধন করে আসছে। একপর্যায়ে আমরণ অনশনে গেলে তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। তবে এ আশ্বাস কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তা নিয়ে এখনো সন্দেহের অবকাশ রয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে ঈপ্সিত বেতন-ভাতার অভাবে কেউ এসব পদে যোগদানের আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এতে দক্ষ-যোগ্য শিক্ষক তো বটেই, পদ পূরণ করার মতো প্রার্থী পর্যন্ত মিলছে না দীর্ঘদিন থেকে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই প্রার্থীদের এ পদে যোগ দিতে আগ্রহী করে তোলা সম্ভব। পাশাপাশি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।
n লেখক: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন। ইত্তেফাক
আপনার মতামত লিখুন :