জাফর আহমদ: পিকেএসএফ-এর চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, অর্থনীতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা এখন অর্থনীতির টেক-অপ বা উড়াল দেওয়ার পর্যায়ে আছি। এখন যে রাস্তা দিয়ে হাটছি তার একটু উপর তলায় চলে যাবো। যেমন একটি বিমান ওড়ার আগে সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখে, তারপর উড়াল দেয়। এখানে গ্যাস আছে কিনা, নাট, বোল্টু ঠিক আছে কিনা দেখে। এ সব ঠিক না থাকলে গন্তব্যে পৌছতে পারবে না, ভেঙ্গে পড়বে। সে রকম অর্থনীতিও উড়াল দেওয়ার আগে সমস্যাগুলো দেখতে হবে। এক সক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বা মানব উন্নয়ন মোটামুটি সব বিবেচনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে এবং এগিয়ে চলেছে। জাতীয় আয় বেড়েছে, বেড়েছে মাথা পিছু আয়ও। এখন মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১,৬১০ মার্কিন ডলার। এটা ২০১৫/০৬ সালে ৫০০ ডলার ছিল। এখানে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সামাজিক বিভিন্ন খাতে অগ্রগতি হয়েছে। যেমন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই এখনও মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেদিকে নজর দিতে হবে। কৃষি খাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটানোর মত খাদ্য-(ধান ও গম) আমাদের কৃষি থেকে পাচ্ছি। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সমস্যা হয়। এবার বন্যা হওয়ার কারণে সমস্যা হয়েছে। অর্থ্যাৎ স্থিতিশীলভাবে পর্যাপ্ত উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা ও আয় উপার্জনের বিষয় সামনে চলে আসে। দরিদ্রদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পদক্ষেপ আরো জোরদার করতে হবে। দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি রয়েছে। তা প্রয়োজন অনুসারে আরো বিস্তৃত ও কার্যকর করার দিকে নজর দিতে হবে।
গ্রামে কর্মসংস্থান বেড়েছে উল্লেখ করে খলীকুজ্জমান বলেন, এখন মজুরি ১০/১১ কেজি চালের সমপরিমান। ১৯৮০-এর দশকে সাড়ে ৩ কেজি দাবিই ছিল। যেসব এলাকায় এবং যখন কাজের সুযোগ কম তখনও ৫/৬ কেজি চালের সম পরিমান মজুরি এখন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এখন তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক এগিয়ে গেছে। ইউনিয়ন পর্যন্ত তথ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। স্থানীয় মানুষ তথ্য জানতে পারেন, টাকা আদান প্রদান করছেন।
তিনি বলেন, এখন বিভিন্নখাতে অর্জিত অগ্রগতি সুসংহত ও ত্বরান্বিত করতে হবে। এক্ষেত্রে, তিনি বলেন, আমাদের মানব সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতা বেড়েছে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি ও সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে, এখন সেজন্য এবং আধুনিকায়ন করতে আরো অনেক দক্ষ হাত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা প্রয়োজন। সুতরাং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রশিক্ষিত আরও অনেক মানুষ তৈরি করতে হবে। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের অনেক করণীয়; এক খাতে নয় বিভিন্ন খাতে।
এক পর্যায়ে নয়, বিভিন্ন পর্যায়ে। যারা অতি দরিদ্র তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অর্থনীতিতে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য তাদের হাতে সম্পদ তুলে দিতে হবে। দারিদ্র্যদের আয় বাড়লে সামাজিক বৈষম্যও কমবে। গ্রামীণ খাতে কৃষিতেও ক্রমান্বয়ে আরো যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। যান্ত্রিকীকরণ করতে হলে দক্ষ মানুষের দরকার। বাজারজাতকরণ সুষ্ঠুভাবে, সঠিকভাবে করতেও দক্ষ মানুষের প্রয়োজন। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন সরকারি অনুকূল নীতির আলোকে এসকল ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব কার্যকরভাবে করতে যারা সেই কাজ করবেন তাদের দক্ষতা থাকতে হবে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের কর্মসূচী বাংলাদেশে এবং সারা বিশ্বে, ২০১৬ সালের জানুয়ারীর ১ তারিখ থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, ২০১৬ সালে ১ জানুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন কার্যক্রম সুষ্ঠু যাতে হতে পারে সে বিষয়ে কাজ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান কি কাজ করবে, কিভাবে কাজ করতে হবে, অর্থায়ন কিভাবে হবে-এই কমিটি এসকল এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করছে। ইতোমধ্যে অনেক কাজ করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে ব্যাপক কর না দেওয়া বা কম দেওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে। এ থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে। আমরা পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে করছি। এ ধরনের আরও নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। এসকল প্রকল্প নিজেদেরকে বাস্তবায়ন করতে কর দেয়ার উপযুক্ত সকলকে যথাযথ কর দিতে হবে।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষি এখনো আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত। যদিও কৃষি থেকে আমাদের জাতীয় আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ আসে। কৃষি মানে শষ্য , পশু সম্পদ , মাছ সব। কেউ কেউ মনে করেন জাতীয় আয়ে কৃষির অনুপাত কমে গেছে বলে জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদানও কমে গেছে। মোটেও তা নয়। উৎপাদন বাড়ছে, জাতীয় আয় বাড়ছে, সেবা বাড়ছে; সেবা এখন জাতীয় আয়ের প্রায় ৫৩ শতাংশ। শিল্পও সম্প্রসারিত হয়েছে। সে জন্য সম্প্রসারিত অর্র্থনীতিতে, জাতীয় আয়ে কৃষির অনুপাত কমেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিন্তু কৃষিখাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এখনো দেশে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৪৫ শতাংশ হচ্ছে কৃষিতে। তাছাড়া কৃষি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ডে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
এছাড়া, খাদ্য মূলত আসে কৃষি থেকে, এবং শিল্প ও অন্যান্য খাতের দ্রব্যাদি ও সেবার অনেক চাহিদাও কৃষিখাতেই। কৃষিকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কৃষিতে অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে সেগুলো গবেষণার মাধ্যমে করণীয় নির্ধারণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক দূর এগিয়েছে। আরো এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। এ সকল কাজ করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে পর্যায়ে বিগত কয়েক বছরে এসেছে সেখান থেকে উড়াল দিতে পারবে। তবে এগুলোতে ঘাটতি থাকলে সমস্যা হবে।
সামনে এগুনোর ক্ষেত্রে দু ধরনের সমস্যা থাকে। কিছু আগে থেকেই থাকে, আর কিছু নতুন করে তৈরি হয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কি কি সমস্যা হবে আগে থেকেই যদি চিহ্নিত করে সমাধানের প্রস্তুতি নেয়া হয় তাহলে সমস্যাগুলো আমাদেরকে আটকাতে পারবে না বলে মনে করেন ড. খলীকুজ্জমান।
তিনি বলেন, যেমন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের সব চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। সেখানে বিভিন্নœ রাজনৈতিক সমস্যা ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রেমিটেন্স কমে গেছে। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে কোথায় সমস্যা হচ্ছে এবং কিভাবে তার সমাধান করা হবে। বিকল্প চিন্তাও করে রাখতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে বলা হয়েছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ একটি উদহারণ। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি একটি উদহারণ। দশক দেড়েক আগেও আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে বাংলাদেশ সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে আমাদের কথা অনেকেই শুনতো না, উঠে যেত। এখন অনেক সময় আমাদের বলাই লাগে না, অন্যরা মানে বিদেশীরাই আমাদের কথা বলে । এই নন্দিত উন্নতি ধরে রাখতে হবে, সুসংহত করতে হবে। এবং সবাইকে ন্যায্যভাবে অন্তর্ভূক্ত করে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :