ডেস্ক রিপোর্ট : প্রতিদিন অনেক ক্যান্সার রোগী তাদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় রেডিয়েশন থেরাপি না পেয়ে সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে ফিরে যান। অপর্যাপ্ত চিকিৎসায় সঠিকভাবে ক্যান্সার নিরাময় না হওয়ায় অনেক রোগীকে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়। অথচ ১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মূল্যের একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর (রেডিও থেরাপি) মেশিন ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাক্সবন্দি পড়ে আছে। যথাসময়ে মেশিনটি স্থাপন সম্ভব হলে গত পাঁচ বছরে অন্তত সোয়া লাখ ক্যান্সার রোগীকে প্রয়োজনীয় সেবা দেয়া সম্ভব হতো।
ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অপরিণত সিদ্ধান্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিনটি নিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অব্যবহৃত পড়ে থাকায় মেশিনটি নষ্ট হওয়ারও উপক্রম হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সচল প্রতিটি লিনিয়ার মেশিনে গড়ে ৮০-৯০ জন রোগীকে রেডিও থেরাপি দেয়া হয়। সেই হিসাবে মেশিনটি স্থাপন হলে মাসে প্রায় ২ হাজার রোগী সেবা পেতেন। পাঁচ বছরে এ সংখ্যা এক লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যেত।
জানা গেছে, ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার সুবিধার্থে ২০১২ সালে রাজস্ব অর্থায়নে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের জন্য কেনা হয় একটি অত্যাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন। ক্যান্সার হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক
ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী জানান, এটি সে সময়ের সর্বাধুনিক মেশিন হওয়ায় তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব হুমায়ুন কবীর এটিকে নিজ জেলা চট্টগ্রামে স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু এতে তিনি আপত্তি করেন। তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বিষয়টি জানতে পেরে এটি তার এলাকা খুলনায় স্থাপনের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনা মোতাবেক মেশিনটি ঢাকার ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে ওই বছরের ৬ নভেম্বর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু খুলনায় এ ধরনের মেশিন স্থাপনের ব্যবস্থা না থাকায় সেটি এখনও বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী যুগান্তরকে বলেন, এ লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিনটি দিয়ে শুধু রেডিও থেরাপি নয়, আরও অনেক কাজ করা যায়। বিশেষ করে রেনাল ক্যান্সার, ব্রেন টিউমার ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষ কার্যকরী। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় মেশিনটি আজও ব্যবহার করা সম্ভব হল না। যথাসময়ে এটি ব্যবহার করতে পারলে অনেক জটিল ক্যান্সার রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হতো। তিনি বলেন, পাঁচ বছর পার হয়েছে। মেশিনটি নির্ধারিত কার্যকালের অর্ধেক সময় অতিবাহিত হয়েছে। এখন এটি কতটা ভালো আছে তা বলা কঠিন। কারণ এ ধরনের মেশিন অব্যবহৃত পড়ে থাকলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিনিয়ার মেশিন স্থাপনের জন্য বিশেষ ধরনের বাঙ্কার তৈরি করতে হয়। উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা নিরোধক বাঙ্কার ছাড়া এ ধরনের মেশিন স্থাপন করা হলে সেটি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। মেশিনটি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপনের জন্য একটি বাঙ্কার তৈরি করা হয়। এটি নির্মাণে গণপূর্ত অধিদফতরকে এক কোটি ৯২ লাখ ৬১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। গণপূর্ত অধিদফতর বাঙ্কার স্থাপনে অপারগতা প্রকাশ করায় এ টাকা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরকে অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর বাঙ্কার নির্মাণ হলেও সেটি আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। এমনকি এ মেশিনটি স্থাপনের জন্য উপযুক্তও নয়। ফলে ২০১৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মেশিন সরবরাহকারী কোম্পানি বাঙ্কার মেরামতে একটি নকশা প্রদান করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরপর ২০১৫ সালের ২ আগস্ট মেশিনটি স্থাপনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানানো হয়। অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর খুলনা মেডিকেল কলেজের বাঙ্কারটি পরিদর্শন করে এবং ৮ সেপ্টেম্বর এ ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৮ মার্চ তারিখে মেশিনটি পুনরায় জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এমনকি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ একটি বাঙ্কার ও কন্ট্রোল রুম করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও ঘটে নতুন বিপত্তি। বাঙ্কার ও কন্ট্রোল রুম তৈরি করতে একটি দরপত্র আহ্বান করে গণপূর্ত বিভাগ। যেখানে ইলেকট্রিফিকেশন, এসি, চিলার, ক্যাবলিং ইত্যাদি কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। অথচ এসব ছাড়া বাঙ্কার কোনো কাজে আসবে না। আবার বাঙ্কার নির্মাণের পর এসব কাজ করতে আরও অন্তত ৫০ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে। অন্যথায় মেশিনটি সচল করা সম্ভব হবে না।
ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর দেশে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার রোগী মৃত্যুবরণ করে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর হার শতকরা ৭ দশমিক ৫ ভাগ। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ এ হার ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। দেশে ক্যান্সারের এ করুণ দশার পরও কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) অধ্যাপক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, লিনিয়ার মেশিনটি চূড়ান্তভাবে জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে বাঙ্কার নির্মাণে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে এটি স্থাপন হবে। ৫ বছরের বেশি সময় মেশিনটি অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের মেশিন অব্যবহৃত থাকলে সমস্যা হতেই পারে। তবে স্থাপন না করে আগেই মন্তব্য করা ঠিক হবে না। মেশিনটি কেন এতদিন ফেলে রাখা হল জানতে চাইলে তিনি বলেন, সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা না করেই মেশিনটি ঢাকা থেকে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানে স্থাপন করা সম্ভব না হওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র : যুগান্তর
আপনার মতামত লিখুন :