মো. আবদুল কুদ্দুস : ১৬ ডিসেম্বর তারিখ বাঙালি জাতির উৎসবের দিন। এদিন মহান বিজয় দিবস। বিজয় দিবসে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিপাঠে মেতে উঠে। শাসক থেকে সাধারণ মানুষ একে অপরকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায়। সামর্থ্যবানদের বাড়ি বাড়ি নানামাত্রিক খাবারের আয়োজন হয়। এই দিনে জেলখানা থেকে শাস্তি মাফ করে অনেক কয়েদিকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের এই দীর্ঘ নয় মাস বীর বাঙালি নিজেদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে অর্জন করেছে এই মহান বিজয়। বিজয়ের আজ ৪৬তম বছর। পাকিস্তান নরপিশাচদের সশস্ত্র হামলায় বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশ (২/৩) অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়। যুদ্ধাহত প্রতিটি বীর বাঙালি তবুও আশায় বুক বাধে ক্ষুধা দারিদ্র্য, শোষণমুক্ত আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার। তাদের প্রত্যেকের স্বপ্ন ছিল এই যে, আমি অভাগা ছিলাম! আমার জন্ম হয়েছে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিপিড়ীত নির্যাতিত দুঃখি পিতা-মাতার ঘরে! সেটি ছিল আমার জন্য বঞ্চনার। সেই জন্যই সেদিন আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। জীবনকে তুচ্ছ করে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেই মহান মানুষদের ত্যাগ তিতিক্ষার ফল বাংলাদেশের মানুষ আজ ভোগ করছে।
ষোল কোটি বাঙালির সেই অশেষ শক্তি ও অনুপ্রেরাণায় বাংলাদেশ যে সমস্ত খাতে ঈর্ষণীয় উন্নয়ন করেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তুলে ধরা হলো:-
কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি : বিগত আট বছরে দেশে-বিদেশে দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১৬ সালে রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। ৫ কোটি মানুষ নি¤œবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যালোচনা থেকে জানা যায় যে, ২০১০-১১ থেকে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে দেশের ভেতরে নতুন সাড়ে ৪৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
ব্যবসা বাণিজ্য ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ : কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষে নতুন উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ, মূলধন ব্যয় কমানো, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সব বিষয়ে কাজ করছে বর্তমান সরকার। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ আগের তুলনায় ভালো হয়েছে বলতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী ও যুবসমাজের কল্যাণ : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় গ্রামীণ জনগণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার বিগত অর্থ বছরে (২০১৬-২০১৭) ১,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। ২০২০ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে নেওয়া বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১১ সালে এক হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে বাড়িয়ে ৮ হাজার ১০ কোটি টাকা করে তৃতীয়বারের মতো একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা : একটি দেশের মানুষের নিকট ‘স্বাধীনতা’ কথাটি অর্থবহ হয় তখনই যখন সেদেশের মানুুষ অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি লাভ করে। মহান বিজয় দিবসের অনুপ্রেরণায় জাতি আজ সেই শক্তির পূর্ণ অর্জনের পথে হেঁটে চলেছে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বর্তমান সরকার এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরি ও দেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের পর্যায়ে উন্নীত করার প্রচেষ্টায় দেশের বিভিন্নপ্রান্তে মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে ।
তথ্যপ্রযুক্তি খাত : বর্তমানে ৮০০ এর উপরে নিবন্ধিত তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কাজ করছে এবং ৩০ হাজারের বেশি তরুণ সংশ্লিষ্ট পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। সরকার তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশ ত্বরান্বিত করতে নানা ধরণের কর্মসূচি ও প্রণোদনার ব্যবস্থা রেখেছে। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের উপর জোর দিয়েছে। সরকারের আইসিটি বিভাগ পরিচালিত লেভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভরনেন্স, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে দেশের তরুণদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা : আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়েছে এক অনন্য উদ্যোগ। যুদ্ধাহত ও ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নির্মাণ করা হযেছে বীর নিবাস। ইতোমধ্যে সিলেটে ৬২টি বীর নিবাস হস্তান্তর করা হয়েছে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতা বর্তমানে ১০,০০০ টাকা এবং ভাতাভোগীর সংখ্যা ২ লক্ষে উন্নিত করা হয়েছে। জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ৬৭৬ জন খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ৩০,০০০ টাকা এবং বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক ১৫,০০০ টাকা, বীর উত্তমদের জন্য ২৫,০০০ টাকা, বীর বীক্রমদের জন্য ২০,০০০ টাকা হারে সম্মানী ভাতা চাুল করার প্রস্তাব মন্ত্রীসভায় অনুৃমোদিত হয়েছে।
শিক্ষা : বর্তমানে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নীট ভর্তির সংখ্যা ১০০ শতাংশে উন্নিত হয়েছে। ঝরে পড়ার হার হ্রাস পেয়ে ২০.০৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৫৩ হাজার ৯২৯ জন শিক্ষার্থী মধ্যে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২২ হাজার ২৪৫টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। ঢাকায় একটি অটিস্টিক একাডেমি স্থাপনের জন্য দুটি হোস্টেল নির্মাণ করা হবে যেখানে প্রতিটিতে ১০০ জন অটিস্টিক শিশুর আবাসনের ব্যবস্থা হবে।
দেশের ৬৪ জেলা ও ৪২১ উপজেলার হাসপাতাল থেকে মোবাইল ফোনে ১৬২৬৩ নম্বরে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞান শিক্ষা ও এর চার্চা বেড়েছে বহুগুনে।
লেখক : শিক্ষক, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি রাজশাহী
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
আপনার মতামত লিখুন :