শিরোনাম
◈ গাজীপুরে হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু  ◈ বিশৃঙ্খলার পথ এড়াতে শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী ◈ তাপপ্রবাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা ◈ সোনার দাম কমেছে ভরিতে ৮৪০ টাকা ◈ ঈদযাত্রায় ৪১৯ দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৮: যাত্রী কল্যাণ সমিতি ◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সেই সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও)

প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:৩৫ সকাল
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:৩৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ বাস্তবায়নই স্মরণের প্রকৃত পথ

আফসান চৌধুরী : বাংলাদেশের জন্য ১৪ ডিসেম্বর একটি ভয়াবহ দিন। ১৯৭১ সালের এদিনে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পাকিস্তান এ কাজটি করে পরাজয়ের লগ্নে এসে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের কাছে তো বটেই, পুরো দেশবাসীর কাছে এদিনটি অত্যন্ত হূদয়বিদারক ও দুঃখের। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন রাতের আঁধারে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এ দেশ আক্রমণ করে, তখনই বুদ্ধিজীবীদের প্রথম হত্যা করা হয়। মার্চে পাকিস্তানিদের আক্রমণের ধরন ও অবস্থান দেখলে বোঝা যায়, কাদেরকে তারা প্রধান শত্রু মনে করছিল। পাকিস্তানিরা তাদের প্রধান শত্রু মনে করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের। তারা শত্রু ভেবেছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীকে। এছাড়া পাকিস্তানের টার্গেট ছিল বস্তিবাসী। এ কারণে তারা ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা, পিলখানা, রাজারবাগ, বস্তি এলাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এলাকাকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। এ ছকের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের প্রথম হত্যা করা হয় মার্চে। যদিও আমরা ১৪ ডিসেম্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি। এটিকে শুধু দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে উদ্দেশ্য সফল হবে না। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তাদের স্মরণ করা উচিত। এটিই প্রকৃত পথ।

পাকিস্তানিরা ধারণা করেছিল, বাংলাদেশ জন্মের ধারণাটি গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। যদি এদের মেরে ফেলা যায়, তাহলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু এটি যে সবার আন্দোলন, সেটি পাকিস্তানিরা ধরতে পারেনি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধঃপতন কতটা হয়েছিল যে, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, গোয়েন্দা সংস্থা জানত না, বাংলাদেশ স্বাধীন করার আন্দোলনটি একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে তত দিনে; যা দমন করার নয়, সেটি এ আক্রমণ থেকে বোঝা যায়। মার্চের পর পাকিস্তানিরা ঢাকার বাইরে আক্রমণ শুরু করে। এপ্রিল মাসটা তাদের গেছে যুদ্ধ করতে। এটাকে আমরা বলি প্রতিরোধের সময়। কারণ বাংলাদেশ ২৬ মার্চই স্বাধীন হয়েছে। তারপর বাংলাদেশকে রক্ষা করার প্রথম পর্যায় হচ্ছে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। যতক্ষণ না পাকিস্তানিদের এখান থেকে বিতাড়ন করা হয়েছিল, সেটি যুদ্ধের বাকি অংশ। জনগণের ধারণা ছিল, মার্চের পর বাংলাদেশকে দখল করে নিচ্ছে পাকিস্তানিরা। এটি প্রতিরোধ করতেই বাংলাদেশীরা অস্ত্র ধরেছিল। বাংলাদেশকে পুনর্দখলের যুদ্ধ শুরু করেছিল বাংলাদেশীরা। এ যুদ্ধ শেষ হয়েছে ডিসেম্বর মাসে। এ সময় দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ করেছে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের ভূমিকা পালন করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, গোটা বাংলাদেশ তার নিজের অবস্থান থেকে যুদ্ধ করেছে।

বুদ্ধিজীবীদের কেন হত্যা করা হলো? মানুষ বলে জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্যই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। মেধাশূন্য করে দেয়ার তো একটা দিক রয়েছেই। আমার কাছে মনে হয় তার চেয়েও বড় বিষয়, সীমিত মেধার মধ্যে পাকিস্তানিদের ধারণা ছিল, বোধহয় বুদ্ধিজীবীরাই জনগণকে শিখিয়েছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। এ ধারণা আমার কেন হলো? আমি যখন পাকিস্তানে গিয়েছিলাম, তখন তারা আমার কাছে এসে বলেছে, তোমাদের স্বাধীনতার মন্ত্র শিখিয়েছেন শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা। পাকিস্তানিরা আমাদের শিক্ষকদের ভয় ও ঘৃণা উভয়ই করত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন যে একটি জাতীয় আন্দোলন, পাকিস্তানিদের মধ্যে এ ভাবনাটাই ছিল না, এখনো নেই। মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাকালে দেখা যায়, পাকিস্তানিরা ভেবেছিল হিন্দু জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বের করে দিলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এতে এটাও বোঝা যায়, বস্তুতপক্ষে কাঠামোগতভাবে পাকিস্তানের একটি বড় সমস্যা ছিল মেধার অভাব। কে তাদের শত্রু-মিত্র, কেন আন্দোলন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে প্রভৃতি বিষয় তাদের চিন্তায় ধরা পড়েনি। এজন্য তারা ভাবল বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয়ই আন্দোলনটা গুছিয়েছে। পাকিস্তানের চোখে হিন্দু, আওয়ামী লীগের কর্মীরা যেমন ছিল বড় শত্রু, তেমনিভাবে বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন তাদের বড় শত্রু। তারা প্রতিশোধ নিচ্ছিল। এভাবে জাতিকে মেধাশূন্য করে দেয়াটা ছিল একটি কারণ। কিন্তু প্রতিশোধের বিষয় ছিল প্রবল। সব জায়গাতেই তারা এটা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বর্তমানে এসে তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় সবক্ষেত্রেই ভালো করছে। এর মাধ্যমেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেব।

শেষ পর্যন্ত যেটা দাঁড়াল— বুদ্ধিজীবীসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ড করেছিল পাকিস্তানিরা, কিন্তু কাণ্ড করেছিল কিছু বাংলাদেশী, যাদের আমরা রাজাকার হিসেবে অভিহিত করে থাকি। বাঙালি পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীদের ছিনিয়ে নিয়েছিল। মেধাশূন্য করার ধারণাটা পাকিস্তানের পক্ষেই করা সম্ভব, কারণ তাদের বুদ্ধি অত্যন্ত কম। যত মানুষকেই হত্যা করা হোক না কেন, কিন্তু এতে একটি জাতির মেধা কোনো দিন শূন্য হয় না, নষ্ট হয় না। এটা মেধাহীনরাই ভাবতে পারে। বিষয়টি অনেকটাই ছিল এমন— তোমরা আমাদের পাকিস্তান নিয়ে গেছ, আমরা তোমাদের হত্যা করব। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় চরিত্র বোঝার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি তা এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হিন্দুদের তারা শত্রু ভাবল। তাদের দেশ থেকে বিতাড়নের নীতি গ্রহণ করল তারা। কিন্তু পাকিস্তানিরা একবারো ভাবল না, দেশ থেকে হিন্দুদের বের করে দিলে ভারতের জন্য সহজ হবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার। এটি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলন, ভারতের তো এটি জাতীয় আন্দোলন ছিল না। কিন্তু এ সুযোগে ভারত তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারল পাকিস্তানকে ভেঙে। একই সঙ্গে তারা বড় মানবিক কাজও সম্পন্ন করল। এ কারণে পাকিস্তান মেধাবীদের অপছন্দ করত। পাকিস্তান কোনো দিনই মেধার ভিত্তিতে তৈরি রাষ্ট্র নয়। এ কারণে তারা মেধাবীদের অপছন্দ করেছে। তাদের ধারণা হয়েছিল, দুটো লোক লিখেছে, পাঁচটা লোক কথা বলেছে আর জনগণ স্বাধীনতা দাবি করে বসেছে। কিন্তু এটি যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, তারা সেটি বুঝতেই পারেনি। পাকিস্তান যে ভয়াবহ আকারে একটি জল্লাদ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, সেটি তারা নিজেরাই বুঝতে পারেনি। এ কারণে তারা জল্লাদের মতো প্রতিশোধ নিয়েছে। এ কারণেই পরাজয়ের শেষ সময়ে এসে তারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। ১৪ ডিসেম্বর পুরো জাতি শোকে মুহ্যমান হয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে। আমরা সামরিক বাহিনীর শহীদদের স্মরণ করছি। একইভাবে আমাদের সাধারণ মানুষদেরও স্মরণ করা উচিত। আমাদের ইতিহাসে সাধারণ মানুষ উপেক্ষিত। সাধারণ মানুষের জন্য দিবস নয় কেন? মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতিত হয়েছে, তার জন্য একটি দিবস নয় কেন?

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। বণিক বার্তা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়