শিরোনাম
◈ বিশৃঙ্খলার পথ এড়াতে শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী ◈ তাপপ্রবাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা ◈ সোনার দাম কমেছে ভরিতে ৮৪০ টাকা ◈ ঈদযাত্রায় ৪১৯ দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৮: যাত্রী কল্যাণ সমিতি ◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও) ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু

প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:০৬ সকাল
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:০৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাঙালির সুমহান বিজয় : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

তোফায়েল আহমেদ : বছর ঘুরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর চার লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে মহত্তর বিজয় আমরা অর্জন করি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন সামনে নিয়ে দীর্ঘ ২৪টি বছর কঠিন সংগ্রাম পরিচালনা করে, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে, ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ আর আমাদের মহান বিজয় সূচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গিয়েছিলাম কলকাতাস্থ থিয়েটার রোডে অবস্থিত প্রথম বাংলাদেশ সরকারের সদর দফতরে। সেখানে অবস্থান করছিলেন শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ অন্যরা। সবাই আনন্দে আত্মহারা! নেতৃবৃন্দ আমাদের বুকে টেনে নিয়ে আদর করেছিলেন। প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা হানাদারমুক্ত করতে পেরেছি, মনের গভীরে যে কী উচ্ছ্বাস কী আনন্দ; সে আনন্দ-অনুভূতি অনির্বচনীয়! স্বাধীন বাংলার যে ছবি জাতির পিতা হৃদয় দিয়ে অঙ্কন করে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র করে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দমাতে পারবে না। ’ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অদম্য বাঙালি জাতি নেতার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সমগ্র বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছিল— জাতীয় মুক্তির ন্যায্য দাবির প্রশ্নে কেউ আমাদের ‘দমাতে’ পারে না।

জাতীয় জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আমার জীবনেও ডিসেম্বর মাস আনন্দ-বেদনার স্মৃতিতে উদ্ভাসিত।

’৭০-এর ডিসেম্বরে মাত্র ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হয়েছিলাম। ’৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু মুজিবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান তুলেছিলাম। বঙ্গবন্ধু সেদিন এই জনপদের নামকরণ করেছিলেন ‘বাংলাদেশ’। সমবেত জনতাকে আহ্বান করে বলেছিলেন, ‘আমার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান তুলুন, ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। ’ ডিসেম্বরের ৭ তারিখে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি এবং ১৭ তারিখ প্রাদেশিক পরিষদের ২৮৮টি আসনে বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ডিসেম্বরের প্রতিটি দিন আমাদের জাতীয় জীবনে সবিশেষ গুরুত্ববহ।
’৭১-এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ থেকে সার্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ অর্জন করে। আমরা তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মুক্তিবাহিনীর চতুর্মুখী গেরিলা আক্রমণে বিধ্বস্ত পাকবাহিনী এদিন উপায়ান্তর না দেখে একতরফাভাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী পশ্চিম ভারতের বিমানঘাঁটিগুলো এমনকি দিল্লির কাছে আগ্রার বিমান ক্ষেত্র এবং পূর্ব ফ্রন্টের আগরতলা বিমানঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ও ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জরুরি বৈঠক শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী রাত ১০টা ৩০ মিনিটে সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। রাত ১২টা ২০ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধী এক বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে সাফ জানিয়ে দেন, ‘আজ এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করল। ’ পরদিন ৪ ডিসেম্বর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যৌথভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জনে চিঠি লেখেন। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল, ‘যদি আমরা পরস্পর আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রবেশ করি, তবে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ অবস্থান অধিকতর সহজতর হয়। অবিলম্বে ভারত সরকার আমাদের দেশ এবং আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করুক। ’ এর পর পরই ভারত পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং ৬ ডিসেম্বর, সোমবার, ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় ভারত সরকার স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’কে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ’৭১-এর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে গৃহীত রাষ্ট্রের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ উদ্ধৃত করে লোকসভার অধিবেশনে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘বাংলাদেশ “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত হবে। ’ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তৃতার পর লোকসভার সব সদস্য দাঁড়িয়ে তুমুল হর্ষধ্বনির মাধ্যমে এই ঘোষণাকে অভিনন্দন জানান। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার ও জনসাধারণের ভূমিকা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ও মুজিববাহিনীর জন্য ৭ ডিসেম্বর ছিল এক বিশেষ দিন। এদিন মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত অঞ্চল যশোর হানাদারমুক্ত হয়। যশোরের সর্বত্র উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সেদিন সরকারের নেতৃবৃন্দ ও মুজিববাহিনীর কমান্ডারগণসহ আমরা বিজয়ীর বেশে স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রুমুক্ত প্রথম মুক্তাঞ্চল যশোরে প্রবেশ করি। জনসাধারণ আমাদের বিজয়মাল্যে ভূষিত করে। সে আনন্দ-অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অনেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মুজিববাহিনীর ভুল বোঝাবুঝির কথা বলেন। এটা সঠিক নয়। আমাদের হেডকোয়ার্টার ছিল কলকাতা বেইজড। আমি নিয়মিত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। মনে পড়ে জেনারেল ওবানের কথা। তিনি দেরাদুনে আমাদের ট্রেনিং দিতেন। জেনারেল সরকার ও শ্রী ডি পি ধর, যারা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে কো-অর্ডিনেট করতেন। এখানে কারও ব্যক্তিগত খামখেয়ালির কোনো অবকাশ ছিল না। সবাই ছিলেন সুসংগঠিত, পরিকল্পিত এবং সুশৃঙ্খল। সমগ্র বাংলাদেশকে চারটি বৃহৎ অঞ্চলে বিভক্ত করে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংগঠিত ছিল মুজিববাহিনী। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর (এফএফ) সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে মোকাবিলা করাই ছিল মূলত মুজিববাহিনীর কাজ। মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে আমার দায়িত্বে ছিল পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল এবং পটুয়াখালী। শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ভাইয়ের দায়িত্বে ছিল তৎকালীন চট্টগ্রাম ডিভিশন; আবদুর রাজ্জাকের দায়িত্বে ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জসহ এক বিরাট অঞ্চল; উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। মুজিববাহিনীর ট্রেনিং হতো দেরাদুনে। দেরাদুন থেকে ট্রেনিং শেষ করে আমার সেক্টরের যারা তাদের প্লেনে করে ব্যারাকপুর ক্যাম্পে নিয়ে আসতাম। মুজিববাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের প্রাক্কালে সজল চোখে বুকে টেনে, কপাল চুম্বন করে বিদায় জানাতাম। আমরা মুজিববাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু মুজিবকে উদ্দেশ করে বলতাম, ‘প্রিয় নেতা! তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো, জানি না! যতক্ষণ আমরা প্রিয় মাতৃভূমি তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না। ’ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর যেদিন বিজয়ী হলাম, সেদিন আমরা সত্যিই মায়ের কোলে ফিরে এলাম। ১৮ ডিসেম্বর আমি এবং শ্রদ্ধেয় নেতা আবদুর রাজ্জাক— আমরা দুই ভাই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আসি। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করি। চারদিকে সে কী আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শ্রদ্ধেয় ভাবী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারকে যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে কেবলই মনে পড়ছিল প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কথা। যে স্বাধীন বাংলার স্লোগান তুলেছিলাম রাজপথে; যে বাংলার জন্য বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্বে কাজ করেছি; পরমাকাঙ্ক্ষিত সেই বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমরা হানাদারমুক্ত, স্বাধীন। বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে, দল-মত-শ্রেণি নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে, আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ২২ ডিসেম্বর। বিমানবন্দরে নেতৃবৃন্দকে বিজয়মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাই। চতুর্দিকে লাখ লাখ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে সর্বত্র মুখরিত। চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মহাসমাবেশ আর আনন্দ মিছিল। মানুষ ছুটে আসছে আমাদের দেখতে। বিজয়ের সেই সুমহান দিনগুলোয় সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে গৌরবের যে দীপ্তি আমি দেখেছি, সেই রূপ বিজয়ের গৌরবমণ্ডিত আলোকে উদ্ভাসিত। স্বজন হারানোর বেদনা সত্ত্বেও প্রত্যেক বাঙালির মুখে ছিল পরম পরিতৃপ্তির হাসি; যা আজো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে কেবলই মনে পড়ছিল প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কথা। যার সঙ্গেই দেখা হয়, সবার একই প্রশ্ন, ‘বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কবে ফিরবেন?’ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সর্বস্তরের মুক্তিকামী বাঙালির ঘরে ঘরে রোজা রাখা, বিশেষ দোয়ার আয়োজন চলছিল। বঙ্গবন্ধুবিহীন বিজয় অপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন না হলে ডিসেম্বরেই বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হতো। কিন্তু আমরা জানতাম বীর বাঙালির ওপর নেতার আস্থার কথা। তিনি তো গর্ব করে বলতেন, ‘তারা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু বাংলার মানুষকে তারা দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ওরা আমাকে হত্যা করলে লক্ষ মুজিবের জন্ম হবে। ’ ১৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়ে বিজয় অর্জন করার পরও আমরা নিজেদের স্বাধীন ভাবতে পারিনি। কারণ, বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেছি সেদিন, যেদিন ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বুকভরা আনন্দ আর স্বজন-হারানোর বেদনা নিয়ে জাতির পিতা তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।

ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের পূর্বপরিকল্পিত নীলনকশা অনুযায়ী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিদের দোসর এ-দেশীয় রাজাকার-আলবদর বাহিনীর ঘাতকরা। ডিসেম্বর মহান বিজয়ের গৌরবমণ্ডিত মাস হলেও ১৪ ডিসেম্বর আমাদের বেদনার দিন। মনে পড়ে নির্ভীক সাংবাদিক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের কথা। যার কাছে আমি ঋণী। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোয় যিনি আমাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। মনে পড়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী সর্বজনাব মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দীন আহমদ, আনোয়ার পাশা, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. আবুল খায়েরসহ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা। জাতির মেধাবী সন্তানদের হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা আমাদের মেধাহীন জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলোয় সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল দেশমাতৃকার স্বাধীনতার সূত্রে। জাতীয় ঐক্যের অভূতপূর্ব নিদর্শন ছিল সেই দিনগুলো। ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-কৃষক-শ্রমিক-যুবক সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণে সফল জনযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছি সুমহান বিজয়। আর এখানেই নিহিত আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক সাফল্য। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে একটি নিরস্ত্র জাতিকে তিনি সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। আমরা সেদিন স্লোগান দিয়েছি— ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’; ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি। সেদিন কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান— এসব প্রশ্ন ছিল অবান্তর। আমাদের মূল স্লোগান ছিল ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি। ’ আমাদের পরিচয় ছিল, ‘আমরা সবাই বাঙালি’। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, যে পাকিস্তানের কারাগার বঙ্গবন্ধুকে আটকে রাখতে পারেনি; মৃত্যুদণ্ড দিয়েও কার্যকর করতে পারেনি। অথচ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পরাজিত শক্তির দোসর খুনি মোশতাক-রশীদ-ফারুক-ডালিম চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করল! যে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাকে ছেলেহারা, পিতাকে পুত্রহারা, বোনকে স্বামীহারা করেছিল; জেনারেল জিয়া তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সংবিধান থেকে উৎপাটিত করেছিলেন। পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানে প্রতি মুহূর্তে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি তাতে কেবলই মনে হয়েছে, বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী, আর পরাজয়ের গ্লানি দীর্ঘস্থায়ী!

একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করার জন্য আমি গত ২৬ ও ২৭ নভেম্বর কলকাতা গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কলকাতার যে বাড়িতে আমরা ছিলাম; সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা— এবার সেখানে গিয়েছিলাম। যদিও সেই অতীতের স্মৃতি এখন আর নেই। গিয়েছিলাম ব্যারাকপুর। যেখানে মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যদের নিয়ে আমি অবস্থান করতাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সীমান্তে নিয়ে তাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাতাম। কিন্তু ব্যারাকপুরে যেখানে আমি ছিলাম সেটা এখন ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হওয়ায় তার স্মৃতি এখন আর নেই। গিয়েছিলাম ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠেছিল চার জাতীয় নেতা— যারা এখান থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকাকালে বঙ্গবন্ধু যে হোস্টেলে থাকতেন সেই বেকার হোস্টেলে গিয়েছিলাম। সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ’ নামে একটি কক্ষ দেখে অভিভূত হয়েছি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। তিনি যে একদিন মহান নেতা হবেন স্মৃতিকক্ষটি সেই স্বাক্ষর বহন করছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানাদি যেখান থেকে পরিচালিত হতো সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে এখন মানুষ থাকে। ভিতরে প্রবেশ করতে পারিনি। বাড়িটির সামনে দাঁড়ালে মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠেছিল।

প্রতিপক্ষের শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচক আজ ইতিবাচকভাবে অগ্রগতির দিকে ধাবমান। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি; যুদ্ধবিধ্বস্ত ঘরে ঘরে ছিল খাদ্যাভাব। কিন্তু আজ দেশে ১৬ কোটি মানুষ এবং খাদ্যভাণ্ডার পরিপূর্ণ। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি ছিল ৩৪৮ মিলিয়ন ডলার; এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে গেছে। আগামীতে মহান বিজয় দিবসের ৫০তম বার্ষিকী উদ্যাপনের প্রাক্কালে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা আমরা স্থির করেছি ৫০ বিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না বললেই চলে। অর্থাৎ প্রায় শূন্য হাতে যাত্রা করে আজ আমাদের রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল মাত্র ৫০-৬০ ডলার, আজ তা ১৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। আর পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) অনুসারে ২০০০ ডলারের অধিক। বিশ্বের প্রধান প্রধান জরিপকারী সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশ হচ্ছে উদীয়মান ১১টি দেশের অন্যতম। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টমতে সামাজিক খাতের অগ্রগতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত থেকে এগিয়ে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে। ’ যেমন আমাদের রপ্তানি, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, বিদ্যুৎ উৎপাদন পাকিস্তান থেকে বেশি। আবার সামাজিক খাতে আমাদের গড় আয়ু ভারত, পাকিস্তান থেকে বেশি। মাতৃমৃত্যু হার, শিশুমৃত্যু হার, জন্মহার ভারত, পাকিস্তান থেকে কম। নারীর ক্ষমতায়নেও আমরা এগিয়ে। আমাদের দেশে এখন শতকরা ৮২ জন বিদ্যুৎ সুবিধা পায়। ২০২১ সালের মধ্যে আশা করি শতভাগ মানুষকে আমরা বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে পারব। অর্থাৎ সামগ্রিকতায় বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে বিকাশমান। যদিও আমরা এখনো স্বল্পোন্নত। তথাপি আমরা জনসাধারণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আমাদের আশাবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘রূপকল্প’ অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে। ইতিমধ্যে আমরা নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যথাক্রমে ‘সিপিএ’ ও ‘আইপিইউ’র সর্বোচ্চ পদে আমাদের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে বিদেশের মাটিতে স্বদেশের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। মহান বিজয় দিবসের ৪৬তম বার্ষিকীতে আজ গর্ব করে বলতে পারি, যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আজ তা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। শিগগিরই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করবে। আজ দেশ যখন অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। যারা স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী এবং যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সংবিধান পরিবর্তন করেছিল, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে যারা বাতিল করেছিল এবং যারা দেশের স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ ধ্বংস করেছিল — আজ ভাবতে ভালো লাগে আমরা সেই স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করেছি। জাতির পিতার হত্যার বিচার শেষ করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ইতিমধ্যে অনেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, বাকিদের বিচারকার্য চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ আজ মর্যাদাশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দুটি স্বপ্ন ছিল— একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অন্যটি বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। একটি তিনি পূর্ণ করে গিয়েছেন। আরেকটি আজকে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

[email protected]। বাংলাদেশ প্রতিদিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়