ডেস্ক রিপোর্ট : বছরজুড়ে আলোচিত ঘটনার অন্যতম রাজধানীর বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনা। চলতি বছরের ২৮ মার্চ ঘটনাটি ঘটে। এরপর কেটে গেছে কয়েক মাস। তদন্তসহ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই ঘটনাটি।
ঘটনার ৩৯ দিন পর ৬ মে রাতে পাঁচজনকে আসামি করে এক ভুক্তভোগী মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলেন-সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, বিল্লাল হোসেন, সাদনান ও সাকিফ। এদের মধ্যে সাফাত আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের ছেলে।
ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে সামাজিক মূল্যবোধ, ধনীর দুলালদের নিয়ন্ত্রণহীন মাদক ও যৌনাচারের বিকৃতরূপ সামনে আসে। প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের লুকানোর চেষ্টা করেও এক এক করে মামলায় অভিযুক্ত সব আসামি গ্রেপ্তার হন।
শেষদিকে উল্লেখযোগ্য তৎপরতা চোখে পড়লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শুরুর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এক পর্যায়ে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।
যা ঘটেছিল রেইন ট্রি হোটেলে
২৮ মার্চের সেই রাতে কি ঘটেছিল অভিজাত এলাকা বনানীর তারকা হোটেল দ্য রেইন ট্রিতে? সচেতন পাঠকমাত্রই ইতোমধ্যে সব অবগত হয়েছেন। তবুও ভিকটিমদের একজনের জবানিতে জেনে নেওয়া যাক।
ঘটনার পর বনানী থানায় দায়ের মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী এক তরুণী উল্লেখ করেন, ‘আসামিরা ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত বনানীর দ্য রেইন ট্রি’ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আমাকে, আমার বান্ধবী এবং এক বন্ধুকে আটকে রেখে সবাইকে মারধর করে। অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে অশ্লীল গালিগালাজ করে।’
‘রুমের মধ্যে নেশাজাতীয় মদ্যপান করে আমাকে এক নম্বর আসামি এবং আমার বান্ধবীকে দুই নম্বর আসামি জোরপূর্বক একাধিকবার ধর্ষণ করে।’
‘তিন নম্বর আসামি সাকিফকে দুই বছর ধরে চিনি। তার মাধ্যমে এক নম্বর আসামির সঙ্গে পরিচিত হই। গত ২৮ মার্চ তার জন্মদিন উপলক্ষে এক নম্বর আসামির গাড়িচালক ও দেহরক্ষীকে পাঠিয়ে আমাদের নিকেতন হতে বনানীর রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়।’
হোটেলের ছাদে বড় অনুষ্ঠান হবে বলে আমাদের নেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে ওই তরুণী এজাহারে বলেন, ‘যাওয়ার পর ওরা ছাড়া আর কোনো লোক দেখি নাই। পরবর্তীতে জোরপূর্বক ধর্ষণের সময় গাড়িচালককে ভিডিও করতে বলে সাফাত।’
‘ঘটনার প্রতিবাদের কথা বললে নাঈম আমাকে মারধর করে। পরবর্তীতে আমাদের বাসায় দেহরক্ষী পাঠিয়েছিল আমাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য। এতে ভয় পেয়ে যাই এবং লোকলজ্জা ও মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলা করতে বিলম্ব হয়।’
ধর্ষণের পর গর্ভনিরোধ পিল খাওয়ানোর চেষ্টা
দুই তরুণীকে ধর্ষণের পর অভিযুক্তরা গর্ভনিরোধ পিল খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এজন্য তারা তরুণীদের সাথে যাওয়া বন্ধু ডা. শাহরিয়ারকে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেন। ডাক্তার শাহরিয়ার রাজি না হলে তাকে প্রচণ্ড মারধর করে এবং সামনে ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে ভিডিও করে ব্লাকমেইলেরও চেষ্টা চালানো হয়। যেন সে ভয়ে এসব ঘটনা কাউকে না বলে।
৩৯ দিন পর মামলা
ঘটনার ৩৯ দিন পর ৬ মে রাতে পাঁচজনকে আসামি করে মামলাটি দায়ের করা হয়। আসামিরা হলেন-সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, বিল্লাল হোসেন, সাদনান ও সাকিফ।
৪০ দিন পর ডাক্তারি পরীক্ষা
৭ মে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীকে ফরেনসিক টেস্টের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল নেওয়া হয়। সেখানে ডা. সোহেল মাহমুদের অধীনে ওই দুই তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়।
ওইদিন এ ঘটনায় ধর্ষকদের ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
তিনি লিখেছিলেন, ‘আপনারা যারা সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, বিল্লাল হোসেন, সাদনান ও সাকিফকে চেনেন, তারা দয়া করে বনানী থানায় বিস্তারিত জানান এবং ছবি প্রকাশ করুন। যেন অন্য কেউ তাদের খোঁজ দিতে পারে।’
আদালতে দুই তরুণীর জবানবন্দি
১১ মে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিনের আদালত এ জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
একেক করে গ্রেপ্তার ৫ আসামি
১১ মে রাতে সিলেটের মদিনা মার্কেট এলাকার রশীদ ভিলা থেকে মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ ও তৃতীয় আসামি সাদমান সাকিফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ধর্ষণের ভিডিও ধারণকারী বিল্লাল হোসেনকে ১৫ মে গ্রেপ্তার করেছিল। একই দিন দেহরক্ষী রহমতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
১৭ মে রাতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে অভিযান চালিয়ে আলোচিত এই ধর্ষণ মামলার দ্বিতীয় আসামি নাঈম আশরাফকে গ্রেপ্তার করে।
যে কারণে ধর্ষণের আলামত মেলেনি
১ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ প্রতিবেদন জমা দেন। তখন তিনি সাংবাদিকদের জানান, ওই দুই তরুণীর মাইক্রোবায়োলজি, রেডিওলজি ও ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু, ওই দুই তরুণীর স্পামে বীর্যের অস্তিত্ব মেলেনি। ঘটনার অনেক পরে ডাক্তারি পরীক্ষা করায় প্রশাণ পাওয়া যায়নি বলেও জানান চিকিৎসক।
ধর্ষণ মামলা ট্রাইব্যুনালে
১১ জুন দুই তরুণী ধর্ষণের মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ বদলির আদেশ দেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম হাফিজুর রহমান।
মামলা ও আসামিদের অবস্থান
বর্তমানে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে। মামলার আসামিরা কারাবন্দি।
সূত্র : পরিবর্তন ডটকম
আপনার মতামত লিখুন :