মো. মনিরুল ইসলাম : বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত, উচ্চারিত এবং প্রহসনের প্রসঙ্গটি সম্ভবত মানবাধিকার। ১৯৪৮ সাল থেকে জাতিসংঘের নির্দেশনায় প্রতি বছরের ১০ ডিসেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে সারা বিশ্বে পালিত হয় মানবাধিকার দিবস। একদিকে যখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত পুরো পৃথিবী, অন্যদিকে তখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের আয়োজন চলছে পৃথিবীজুড়ে। সাধারণত মানবাধিকার বলতে মানুষের সেই সব অধিকারকে বোঝায় যা নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করে, যা তাকে মনুষ্যত্বের বিকাশে সহায়তা করে। এসব বিষয় হরণ করলে সে আর মানুষ থাকে না। মানুষকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে অধিকারগুলো দরকার তাই মানবাধিকার। এই অধিকারগুলো সহজ, স্বাভাবিক, সহজাত ও সর্বজনীন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এবং সামাজিক জীব হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মানবাধিকার অপরিহার্য। তবে মানবাধিকার যদি মানবিক বোধ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে প্রভুত্বের বোধে পরিচালিত হয় তবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সে প্রচেষ্টা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এখন যারা মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন, মানবাধিকার ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে মূলত তাদের হাতেই। ক্ষেত্রবিশেষ পরাশক্তির দেশগুলো মানুষ হত্যার দায়মুক্তির হাতিয়ার হিসেবেও ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করছে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবাজ নেতা যারা মানবতার সূচক নিয়ন্ত্রণ করে তারা একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে মানুষ হত্যা করছে মানবতা প্রতিষ্ঠারই নামে। ফলে মানবাধিকার শব্দটি ক্রমশই ‘দানবাধিকারে’ পরিণত হচ্ছে। তাই সেমিনার-র্যালির মাধ্যমে ঘটা করে মানবাধিকার দিবস পালনের আগে মানবাধিকারকে প্রহসনের মোড়ক থেকে মুক্ত করার উপায় নিয়ে ভাবা উচিত।
মানবাধিকারের বিশ্ব ঘোষণা ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ নিঃসন্দেহে যৌক্তিক ভিত্তিতে রচিত। তবে এসব ঘোষণা ও সনদ ব্যবহারিকভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ যারা এ ঘোষণার রূপকার তারা বিশ্বের দুর্বল জাতিগুলোর ওপর আক্রমণের নিশানা এঁকে তাদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠন করছে, মানবাধিকারের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা করছে এবং এসব লুটপাট ও হত্যাকাণ্ডের নাম দিচ্ছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম! মানবাধিকার লঙ্ঘনের এর চেয়ে জঘন্যতম চিত্র আর কী হতে পারে? সাদ্দামের কাছে ইরাকের মানবাধিকার সুরক্ষিত নয়, তাই সহযোগীদের সঙ্গে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকার ইরাক আক্রমণ এবং লাখ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যা— এসব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে প্রহসন ছাড়া আর কী? মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক রাষ্ট্রে ইরাকের মতো চরম অমানবিক অবস্থা হয়েছে পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর রক্তমাখা হস্তক্ষেপে।
মানছি এসব রাষ্ট্রে মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক ছিল, কিন্তু নতুন রকমের মানবাধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে সেখানে যুগ যুগ ধরে যে রক্তপাতের ঘটনা ঘটছে তা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে অবশ্যই মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিও একেবারেই জঘন্য ও অমানবিক। সেখানে জাতিগত উচ্ছেদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণিত অভিযোগ থাকলেও শক্তিশালী কোনো কোনো রাষ্ট্র তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধকে বৈধ বলে মনে করছে। তাদের স্বার্থ হাসিলের কূট-কৌশলের কাছে মানবাধিকার সামান্য বিষয় বটে! মানবাধিকারের স্বীকৃত অভিভাবক জাতিসংঘ যে-বছর থেকে মানবাধিকার দিবস পালন শুরু করেছিল ঠিক সেই বছর থেকে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অথচ ইসরাইল বছরের পর বছর মানবতাবিরোধী অপরাধ করেও পরাশক্তিগুলোর সমর্থন পেয়ে আসছে। মূল কথা, যেসব দেশ পাশ্চাত্যের আধিপত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে না তাদেরকে মানবাধিকারবিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালে সেসব রাষ্ট্রে পরাশক্তিগুলো বাণিজ্যিকভাবে মানবাধিকার রপ্তানির প্রতিযোগিতায় নামে, অনিবার্যভাবে যার ফলাফল রক্তপাত ও মানুষ হত্যা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গুটিকতক পরাশক্তির ভেটো প্রদানের অধিকার নিঃসন্দেহে মানবাধিকারের নির্লজ্জ লঙ্ঘন।
মানবতার প্রশ্নে যারা এমন দ্বিমুখী নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত তাদের হাতে মানবতা মোটেই নিরাপদ নয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উদ্যাপনের শুরু থেকে ৬৯ বছর অতীত হয়েছে। মানবাধিকারের বিশ্বঘোষণায় ৩০টি মনোমুগ্ধকর অনুচ্ছেদ রয়েছে। এ ঘোষণার ৬৯ বছরের পথচলাকে পর্যালোচনা করলে যে চিত্র আমাদের সামনে ফুটে ওঠে তা আশাব্যঞ্জক নয়। ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা আছে— সকল মানব সন্তান স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান মর্যাদা ও অধিকার পাবে। কিন্তু বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের হিসেবে আজ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মানুষ পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়। ঐ ঘোষণার ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে মা ও শিশুর অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলা আছে, কিন্তু বিশ্বে প্রতি বছর ৬ লক্ষ প্রসূতি মায়ের সন্তান প্রসবকালে মৃত্যু হয় এবং বছরে প্রায় ৪৫ লক্ষ নারী পাচারের শিকার হয়। ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বিশ্বের প্রত্যেক নাগরিকের বিনা খরচে প্রারম্ভিক শিক্ষার কথা বলা থাকলেও বছরে প্রায় ৮ কোটি শিশু বিদ্যালয় অঙ্গনে পা রাখারই সুযোগ পায় না। ঘোষণার অন্যান্য অনুচ্ছেদগুলোতেও প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির যে ফারাক তার গাণিতিক হিসাব থাকলেও মানবিক হিসাব নেই। মানবতার ঘোষকরা ঘোষিত অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকারগুলোকে অত্যন্ত সচেতনভাবে উপেক্ষা করে যখন মানবাধিকারকে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তখন তাদের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠা অস্বাভাবিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার মানবাধিকারকে ব্যবসার পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিভিন্ন রকম মানবাধিকার সংস্থা গড়ে উঠেছে যারা লঙ্ঘিত মানবাধিকারকে পুঁজি করে নিজেদের ব্যবসাকে রমরমা করে তুলেছে। মানবাধিকার রক্ষার এসব সংস্থা পরিচালিত হয় মূলত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রগুলোর উচ্ছিষ্ট পয়সায়। মানবাধিকারের সূচকসমূহও নির্ধারিত হয় ঐসব রাষ্ট্রের ইচ্ছায়। এসব এক রকম পাতানো খেলা বটে!
এবার বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া যাক। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যে সংবিধান রচনা করেন সেখানে সুস্পষ্টভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলোর আওতায় প্রজাতন্ত্রকে একটি গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়, নিশ্চয়তা দেওয়া হয় মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার। মানবসত্তার মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। নিশ্চয়তা দেওয়া হয় সব নাগরিকের সুযোগের সমতার। কর্মকে অধিকার ও কর্তব্যরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রত্যেক নাগরিকের চলাফেরা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। বস্তুত ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের প্রায় সব ঘোষণার প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের সংবিধানে। কিন্তু সারা বিশ্বের মতো আমাদের এখানেও মানবাধিকারের প্রাপ্তিতে প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর হতে চললেও এখনো মানবাধিকারসমূহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো, মানবাধিকার নিয়ে যাদের উচ্চকণ্ঠ অনেক সময় তারাই মানবাধিকার হরণ করেছে। জ্বালাও-পোড়াও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্ধকারে অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অথচ এসব রাজনৈতিক দল হতে পারত মানবাধিকারের অভিভাবক। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যাদের হাতে রয়েছে মানবাধিকারের রক্ষাকবচ তাদের হাতেও কখনো কখনো মানবাধিকার হরণ হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে বিচারহীনতা অথবা বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এখানকার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার অস্তিত্ব থাকলেও তাদের তত্পরতা ও উদ্দেশ্য বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দেশে একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। জনগণের কাছে এটি নখদন্তহীন বাঘ হিসেবে পরিচিত। সুশীল সমাজ ও জনগণের অভিযোগ, কমিশন আইন অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। মানবাধিকার লংঘন প্রতিরোধে চোখে পড়ার মতো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তবে একটি বিষয়ে সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারে— স্বাধীনতার অনেক বছর পরে হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পেরেছে।
মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার কমতি নেই বর্তমান বিশ্বে। খণ্ড খণ্ড পরিস্থিতিতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উদাহরণ একেবারেই যে নেই এমনটি নয়। তবে এত আলোচনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতির পরও বিশ্বে মানবাধিকার পরিস্থিতির চোখে পড়ার মতো উন্নতি ঘটছে না। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো তো মানবাধিকারের ব্যাপারে বেশ সোচ্চার, কিন্তু তা কাগজে-কলমে। মানবাধিকার নিয়ে পরাশক্তিগুলোর উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার বিষয়টি তো বিশ্ব-মিডিয়ায় বেশ ফলাও করে প্রচার হয়ে থাকে, কিন্তু খোদ তাদের দেশেই মানবাধিকার নিশ্চিত হয়েছে কি? বিশ্বের যে ৭টি দেশ এখনো নারীর প্রতি বৈষম্যসংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করেনি, যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যতম। এই উদাহরণ থেকে মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ইউরোপ ও আমেরিকার অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহেও অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ভিন্নতর নয়, অথচ তারাই মানবাধিকারের অভিভাবক! মানবাধিকার একটি নৈতিক বিষয়। এটি কোনো পণ্য নয়, প্রচারণার বিষয়ও নয়। মানুষের মধ্যে যদি নীতিবোধ না থাকে তাহলে সে অন্যের অধিকার নিশ্চিত করবে কীভাবে? নীতিবোধের অভাবে মানবাধিকার বিষয়টি এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়মুক্তির হাতিয়ার ও প্রহসনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আদর্শ ও নীতিবোধের অভাবে বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার বিষয়টি যে অনুপাতে প্রচার করা হচ্ছে, ঠিক সেই অনুপাতে মানবাধিকার পদদলিত হচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতি দূর করতে হলে প্রথমেই মানবাধিকারের প্রবক্তাদের প্রহসনের কৌশল থেকে সরে আসতে হবে।
n লেখক :প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
email- monirulislamprism@gmail.com ইত্তেফাক
আপনার মতামত লিখুন :