শিরোনাম
◈ জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রস্তাবে মার্কিন ভেটোর নিন্দা ফিলিস্তিনের, লজ্জাজনক বলল তুরস্ক ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের

প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:৩৪ সকাল
আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:৩৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

নিপীড়িতের মধ্যে নতুন নিপীড়ক

জয়া ফারহানা : প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সেই সুবাদে শিক্ষার মান নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে তখন পাওলো ফ্রেইরির কথা মনে পড়ে। ফ্রেইরির শিক্ষা-চিন্তা গরীব ও নিপীড়িতের পক্ষে বলে নয়। এ কারণেও নয় যে, ফ্রেইরির শিক্ষা চিন্তা সমাজের অবহেলিত নির্যাতিত মানুষকে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে উপলব্ধি করতে শেখায়। এমনকি একারণেও নয় যে, ফ্রেইরি বলেছিলেন, মানুষ যখন তার প্রকৃত অবস্থান বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে শেখে তখন অন্যরা আর তাকে জড় পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। এসব কিছুর জন্য নয়। এ মুহূর্তে ফ্রেইরিকে মনে পড়ার কারণ তাঁর সতর্কবাণী। ফ্রেইরি সতর্ক করেছিলেন নিপীড়িতের মধ্যেই নতুন নিপীড়ক তৈরি হওয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে। শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে, ফ্রেইরির কথা মনে পড়ে। এমন একটি সমাজে আমাদের বসবাস যেখানে লোভীর লোভ আরো বেড়ে যাচ্ছে, দুর্বৃত্ত আরো বেশি দুর্বৃত্তপরায়ণ হয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী যাদের আমরা নিপীড়িত শ্রেণি হিসেবেই চিনি তারা তাদের চেয়ে অধিকতর দুর্বলদের প্রতি নিপীড়ক হয়ে উঠছে।

১ ডিসেম্বর ইত্তেফাকের প্রথম সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে এলাকাবাসীর দাবির মুখে ভুলতা-রামপুরা সড়কে বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালুর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্থানীয় চাঁদাবাজ এবং ফিটনেসবিহীন গাড়িচালকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে বাস চালক ও হেলপারদের ওপর চড়াও হয় এবং বাস পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এতে বাস সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যায়, যদিও সমালোচনার মুখে তা আবার চালু হয়েছে। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে কাঞ্চন হয়ে ভুলতা পর্যন্ত বিশ কিলোমিটার সড়কের প্রায় চারশ’ ট্যাক্সি চলাচল করে এবং এরা যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করে। ফিটনেসহীন এই ট্যাক্সি ব্যবসায় প্রতিদিনের অবৈধ চাঁদার গড় পরিমাণ দেড় লাখ টাকা। উইনস্টন চার্চিলের ধারণা অনুযায়ী এরা হয়ত খড়ের মানুষই। কিন্তু এই জাতীয় খড়ের মানুষের সংখ্যা যখন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায় তখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে খুব নিবিড়ভাবে তাকানোর প্রয়োজনের কথা মনে হয়। অভিযোগের আঙুলের বিপরীতে আমরা যদি এই আরেকটু গভীরে প্রবেশ করি তাহলেও পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষার কথা মনে পড়বে। লক্ষ্য করুন ভুলতা-রামপুরা রুটে চাঁদাবাজির সমাধান হিসেবে সম্পাদকীয়তে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে চাঁদাবাজ এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করার জন্য। যা পাওলো ফ্রেইরিরই শিক্ষা। ফ্রেইরির শিক্ষার দর্শন কেউ স্বঘোষিত শিক্ষক বনে যেতে পারবেন না। নিপীড়িত মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণেরও প্রয়োজন নেই। মানুষকে নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে কী তার প্রয়োজন।

কেউ শিক্ষা দেবে আর কেউ শিক্ষা নেবে এ সম্পর্ককে তিনি নিপীড়কের সঙ্গে নিপীড়িতের সম্পর্কতুল্য ভেবেছেন। আমাদের দেশে ঘটছে বিপরীতটি। এখানে সকলেই শিক্ষক। সকলেই শিক্ষা দিতে চান। যে কারণে পারস্পরিক সম্পর্কের চরিত্র দাঁড়িয়েছে নিপীড়িত ও নিপীড়কের। এ এক গোলমেলে শিক্ষার দর্শন। অবশ্য এই শিক্ষা ব্যবস্থার আদৌ কোনো দর্শন আছে কিনা তাও বোঝা মুশকিল। আমাদের জাতীয় কবি আছে, জাতীয় অধ্যাপকের পদও আছে, কিন্তু জাতীয় দার্শনিক, জাতীয় ঋষি নেই। যে কারণে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তেমন বড়মাপের দর্শনের প্রভাব নেই। চীনের জাতীয় ঋষি যেমন কনফুসিয়াস, অন্য আরও দেশেও আছে। তাওবাদের প্রতিষ্ঠাতা লাওসের কথা বলি। লাওসের দর্শন ছিল ‘আমি ভাল ব্যবহার করব, যারা ভালো নয় তাদের সঙ্গেও, যেন আমি তাদেরকেও ভালো করতে পারি। অবিশ্বাসীদের সঙ্গেও আমি বিশ্বাস রক্ষা করব যেন আমি তাদের বিশ্বাসী করে তুলতে পারি। যদি একজন মানুষ খারাপও হয়ে থাকে তাকে পরিত্যাগ করা কী এমন ভালো কাজ? না আমি তাকে পরিত্যাগ করব না। আঘাত পেলেও আমি তাকে হাসিমুখে তা সহ্য করব।

শিক্ষা নিয়ে আলাপে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর প্রসঙ্গটি প্রায়ই উঠে আসে। শিক্ষকদের বেতন না বাড়ালে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হবে না জাতীয় একটি জনপ্রিয় ধারণাও চালু আছে। কিন্তু আসলে কি তাই? কোনো সর্বজ্ঞ পন্ডিতেরও পান্ডিত্য বিতরণের কৌশল জানা না থাকতে পারে। অথবা জ্ঞান বিতরণে তিনি আনন্দ না পেতে পারেন। শিক্ষকের রাজনৈতিক ধর্মীয় ও নৈতিক গোঁড়ামি থাকলে প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীসহ এর অশুভ প্রতিক্রিয়া সমাজের সব জায়গায় সংক্রমিত হতে পারে। কোন শিক্ষক যদি দ্রোণাচার্যের মত বর্ণবিদ্বেষী হন তবে বর্ণবাদিতা সমাজকে আচ্ছন্ন করতে পারে। মহাভারতের একলব্যের গল্প আমরা অনেকে জানি। একলব্য নিম্ন বর্ণের সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার কারণে কুরু বংশের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের শিষ্য হওয়ার অধিকার পায়নি। গভীর জঙ্গলে দ্রোণাচার্যের মুখ কল্পনা করে তাকে গুরু জ্ঞানে নিজেই অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা লাভ করতে থাকে একলব্য। অস্ত্রবিদ্যা চালনায় একলব্য যখন দ্রোণাচার্যের উচ্চবর্ণের শিষ্য অর্জুনকে ছাড়িয়ে যায় তখন দ্রোণাচার্য একলব্যের কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে তার আঙুল দাবি করে বসেন। ভক্তিমান ছাত্র একলব্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে আঙুলই দিয়েছিলেন।

ভাবার কোন কারণ নেই যে মহাভারতের কাল আমরা পার হয়ে এসেছি। এও ভাবার কারণ নেই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বর্ণভেদ প্রথা উঠে গেছে। প্রত্যক্ষভাবে হয়তো নেই কিন্তু পরোক্ষভাবে কয়েকরকম শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কোচিং এবং গাইড বই নির্ভর শিক্ষা প্রাইভেট পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট দ্রোণাচার্যের মত শিক্ষকের কথা মনে করিয়ে দেয়। শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্যের কথা যেমন মনে পড়ে তেমনি পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষার দর্শনও মনে পড়ে। মনে রাখা দরকার প্রত্যেকটি দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন এসেছে শিক্ষার মাধ্যমে। একসময় সাদা মানুষ এবং দাসদের জন্য আলাদা যানবাহন ছিল। সাদা এবং কালোরা একসঙ্গে এক যানবাহনে চড়তে পারত না। এখন কেউ এ জাতীয় নিয়মের কথা ভাবতেও পারে না, ভাবলেও তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ভাবা হবে। এটা পরিবর্তন বটে। তবে এই পরিবর্তন আসে পাওলো ফ্রেইরির মত শিক্ষা দার্শনিকের চিন্তার সূত্রে।
লেখক :প্রাবন্ধিক। ইত্তেফাক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়