শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে বিভেদের রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়: ওবায়দুল কাদের  ◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী 

প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:৩২ সকাল
আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:৩২ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ভুল, ক্ষমা ও ক্ষমা চাওয়ার চাইনিজ প্যাকেজ!

চিররঞ্জন সরকার : আমাদের রাজনীতিতে ‘ক্ষমা’ নিয়ে বেশ আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষমার সঙ্গে আরেকটি জিনিস খুবই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত তা হলো ‘ভুল’। ভুল হলেই কেবল ক্ষমার প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রধান দুই নেত্রী ‘ক্ষমা’ নিয়ে মুখ খুললেও ‘ভুল’ নিয়ে কিছু বলছেন না। এর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, প্রতিহিংসায় নয়, ক্ষমায় বিশ্বাস করি। আমার এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি শেখ হাসিনার প্রতিহিংসামূলক ও বৈরি আচরণ সত্ত্বেও তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। আমি তার প্রতি কোনো প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করবো না।’

বেগম জিয়ার এই ‘ক্ষমা’ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ক্ষমা করেছেন নাকি ক্ষমা চাচ্ছেন, তা তো স্পষ্ট না। কিসের ক্ষমা করবেন উনি আমাকে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বেঁচে গেছি, সেটা? আমি এমন কোনো অপরাধ করিনি যে ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষমা তো খালেদা জিয়ার চাওয়া উচিত।’

দেখা যাচ্ছে ‘ভুল’ এবং ‘ক্ষমা’ নিয়ে আমাদের প্রিয় দুই নেত্রী একে-অপরের বিরুদ্ধে তীর্যক মন্তব্য ছুড়ছেন। এতে করে ‘ক্ষমা’র মাহাত্ম্য না বেড়ে বরং ‘ভুলের’ সংখ্যা বাড়ছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, মানুষ মাত্রই কিন্তু ভুল হয়। আপনি যেই হোন না কেন, যত বড় পণ্ডিত কিংবা যতই নিরেট মূর্খ, মানুষের ভুল হয় এবং ভুল হতেই পারে। আমাদের দেশের মানুষের, বিশেষ করে দায়িত্ববান মানুষের যেন ভুলটা আরও বেশি বেশি হয়। কিন্তু এদেশে কেউ ভুল স্বীকার করেন না। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা না, রাজনীতিবিদরা না, ব্যবসায়ীরা না, এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও না। তাহলে কি এদেশে কেউ ভুল করেন না? কোথাও কারও কোনও অবহেলা, গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা কিছু নেই?

ভুল স্বীকার করাকে কখনওই নিরুত্সাহিত করা উচিত নয়। কেননা, ভুল স্বীকার করা একটি ইতিবাচক মানবিক ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মে তো ক্ষমাপ্রার্থনার একটি বিশেষ তাত্পর্য আছে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মেই এই ক্ষমাপ্রার্থনার বিশেষ গুরুত্ব আছে। চণ্ডীপাঠের শেষে একটি স্তোত্র পাঠ হয়, ক্ষমাপনস্তোত্র।

আসলে ভুল স্বীকার করতেই হবে। ভুল থেকেই ‘ঠিক’-এ যেতে হয়। যেমন অন্ধকার থেকে আমরা আলোর পথযাত্রী। ঠিক সেভাবেই অসত্য থেকে সত্যের পথে যাত্রা। ফরাসি দার্শনিক রাসেল এক বার মজা করে বলেছিলেন, মাঝে মাঝে ভ্রম হয় যে আমরা একটা সত্য থেকে আর একটা সত্যে যাচ্ছি নাকি একটা অসত্য থেকে আর একটা অসত্যের পথে যাচ্ছি। কারণ, আজ যেটাকে সত্য বলে আঁকড়ে ধরছি, সেটা কাল হয়ে যায় হাইপোথিসিস। আসলে, আমরা একটা হাইপোথিসিস থেকে আর একটা হাইপোথিসিসেই হাঁটছি!

সেদিক থেকে ‘ভুল’ ও ‘ক্ষমা’ও একটা হাইপোথিসিস!

দুই.

চিনে একটি কোম্পানি ছিল, হয়তো এখনও আছে। বেশ কয়েক বছর আগে তার কথা লিখেছিলেন এক মার্কিন সাংবাদিক। কোম্পানিটির কাজ ক্ষমা চাওয়া। অন্যের হয়ে ক্ষমা চাওয়া। ওঁদের স্লোগানই হল: আমরা আপনার হয়ে ‘সরি’ বলব। ব্যাপারটা কী? আসলে ও দেশের মানুষ চট করে ক্ষমা চাইতে পারেন না। সাহেবরা যেমন কথায় কথায় ‘হা-ই, সরি অ্যাবাউট দ্যাট’ বলে কাঁধ ঝাঁঁকিয়ে সব দুঃখ-টুঃখ ঝেড়ে ফেলে নিজের কাজে চলে যেতে পারেন, চিনে অনেকেরই এখনও সেটা রপ্ত হয়নি। এ ব্যাপারে বাঙালি-চিনা ভাই ভাই বলা যায়, আমাদের এ-দিকেও অনেকেই এখনও সাহেবি কেতাবে তেমন অভ্যস্ত হননি, পথে-ঘাটে, বাজারে মার্কেটে কিংবা ট্রেনে-বাসে কারও পা মাড়িয়ে দিয়ে ‘সরি’ বললে নিস্তার মেলে না, উল্টো মুখঝামটা খেতে হয়, ‘ওই এক বুলি শিখিয়ে দিয়ে গেছে ইংরেজরা, বললেই অমনি সাত খুন মাপ হয়ে গেল!’

তবে ভাইয়ে ভাইয়ে সবকিছু তো আর মেলে না, একটা ব্যাপারে চিনের লোকেরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ওস্তাদ। ওরা ব্যবসাটা ফাটাফাটি বোঝেন। ক্ষমা চাইতে লজ্জা, ‘সরি’ বলতে অস্বস্তি এই স্বভাবটাকেই দিব্যি পুঁজি বানিয়ে কেউ কেউ লক্ষ্মীর সাধনায় নেমে পড়েছেন। যেমন ওই কোম্পানিটি। ওরা ক্রেতাদের নানা রকম প্যাকেজ বিক্রি করেন। ক্ষমা চাওয়ার প্যাকেজ। ধরা যাক, দুই বন্ধুর বেধড়ক ঝগড়া হয়েছে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তারপর এক দিন, যেমন হয়, এক বন্ধুর মনটা হু-হু করে উঠল। হয়তো অন্যেরও। কিন্তু বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না, বরফও গলে না। এসব বিপদে তৃতীয় বন্ধুর একটা ভূমিকা থাকে, কিন্তু সমাজ পালটেছে, ভাল বন্ধুর সংখ্যা কমেছে, তেমন বৃন্দা দূতী মেলা কঠিন। এখানেই মুশকিল আসান কোম্পানির প্রবেশ। ওদের সাফ কথা: ক্ষমা চাইতে চান, কিন্তু লজ্জা পাচ্ছেন? চলে আসুন আমাদের কাছে, বলুন আপনার কেস হিস্ট্রি, জানিয়ে দিন কতটা জোর দিয়ে সরি বলতে চান। আমরা আপনার চাহিদা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা করে দেব। আমাদের লোক চিঠি লিখবে, ফোন করবে বা সশরীর চলে যাবে আপনার অভিষ্ঠ মানুষটির কাছে, যথাযথ ভাষায় ও ভঙ্গিতে ক্ষমা চেয়ে আসবে তার কাছে। শুকনো সরি-র সঙ্গে যদি কিছু উপহার দিতে চান, তার ব্যবস্থাও আমরাই করে দেব। দাম প্যাকেজ অনুসারে।

এবং এ কোনো শখের কারবার নয়। ওই কোম্পানিতে যারা কাজ করেন, মানে ক্ষমা চেয়ে বেড়ান, তারা রীতিমত শিক্ষিত, সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে আছেন শিক্ষক, আইনজীবী, সমাজকর্মী। তারা স্বভাবে শান্ত, মগজে বিচক্ষণ, চমত্কার কথা বলেন। তার ওপর তাদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়। ক্ষমা চাইবার ট্রেনিং, যাতে তারা আরো দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। একটা ব্যাপার খেয়াল করা ভাল। এই কাজে দক্ষতার মূল্যায়ন বেশ সহজ। ক্ষমা চাইবার ফলে মনোমালিন্য মিটল কি না, দূরত্ব কতটা কমল, সেটাই বলে দেবে, পেশাদার ক্ষমাপ্রার্থী তার পেশায় কতটা সফল।

মার্কিন সাংবাদিকটির লেখার সূত্র ধরে চিনের এই কোম্পানিটির কথা জানিয়েছেন মাইকেল স্যান্ডেল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রবীণ অধ্যাপক ন্যায়, নীতি, নৈতিকতা নিয়ে অসামান্য সকল লেখা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। ‘জাস্টিস’ নামে তার বক্তৃতামালা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ববিশ্রুত। বছর দুই আগে প্রকাশিত তার লেখা ‘হোয়াট মানি কান্ট বাই’ নামক একটি স্বল্পকায় বইয়ে তিনি আলোচনা করেছেন, আমাদের জীবনের সমস্ত অন্ধিসন্ধিতে বাজার কীভাবে অনুপ্রবেশ করেছে, এমন অনেক কিছুর দখল নিয়েছে যা আমরা আগে বাজারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না। ক্ষমা চাওয়ার চিনাবাজার নিয়ে আলোচনা এসেছে সেই সূত্রেই। খেয়াল করা দরকার, এ বাজার পশ্চিম দুনিয়ায় হয়নি। হবে না, কারণ সেখানে মানুষ অনায়াসে এবং অবলীলাক্রমে ক্ষমা চায়। চিনের মতো দেশে ক্ষমা চাওয়া মানে মুখের কথা নয়, সত্যিই মাথা হেট করা। ‘সরি’ বলাটাকে লোকে সিরিয়াসলি নেয় বলেই সহজে বলতে পারে না, পারে না বলেই এই নিয়ে দিব্যি একটা ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এটা আপাতদৃষ্টিতে একটা প্যারাডক্স বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে এখানেই বাজারের ক্ষমতা। যা কিছু আমাদের কাছে মূল্যবান, বাজার তাকেই আত্মসাত্ করে, সেই মূল্যকে মুনাফায় রূপান্তরিত করে ফেলে! সে পেশাদার প্রতিনিধিকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানোই হোক, হিরের আংটি কিনে ভালোবাসা জানানোই হোক। তাতে শেষ পর্যন্ত মানবিক অনুভূতিগুলোর মূল্য কমে যাবে কি না, মূল্য কমে গেলে বাজারটাই উধাও হবে কি না, সে-সব ভবিষ্যতের ব্যাপার। ভবিষ্যতে আমরা সবাই মৃত।

আমাদের দেশেও ক্ষমা চাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষ করে রাজনীতির লোকেরা চট করে ‘সরি’ বলতে রাজি নন। অথচ প্রতিপক্ষ কেবলই তাদের পুরনো পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে বলে, তাই নিয়ে শোরগোল তোলে। কোনো পক্ষই ক্ষমা চাইবে না, ওদিকে প্রতিপক্ষও ছাড়বে না। তাই ভাবছিলাম, একটা কোম্পানি তৈরি করলে হয় না? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, যেই হোক, যে কারণেই হোক, যখন যেখানে দরকার, যার কাছে দরকার, ক্ষমা চেয়ে আসবে। খরচটা দিয়ে দিলেই হল, ব্যস!

পুনশ্চঃ বামপন্থিদের এই বিকিকিনির আওতার বাইরে রাখা হবে। কারণ তাদের ডিকশানারিতে ‘ভুল’ বলে কিছু নেই! তাই ‘ক্ষমা’ নামক সওদা কেনারও তাদের কোনো দরকার নেই।

n লেখক:রম্য লেখক। ইত্তেফাক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়