শিরোনাম
◈ বিশৃঙ্খলার পথ এড়াতে শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী ◈ তাপপ্রবাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা ◈ সোনার দাম কমেছে ভরিতে ৮৪০ টাকা ◈ ঈদযাত্রায় ৪১৯ দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৮: যাত্রী কল্যাণ সমিতি ◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও) ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু

প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:০৭ সকাল
আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:০৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দুই হাজার টাকায় সমস্যা ‘গায়েব’

 

ডেস্ক রিপোর্ট : মঙ্গলবার দুপুর ২টা। ১৫ থেকে ২০ জন মানুষের জটলা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ষষ্ঠ তলায়। সবাই এসেছে কোনো না কোনো কাজে। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে মন্ত্রণালয়ের সেবাদান কেন্দ্র। দেরিতে আসা এসব মানুষ প্রয়োজনীয় তথ্য কার কাছ থেকে পাবেন, তার কোনো উত্তর দিতে পারছেন না মন্ত্রণালয়ের প্রবেশমুখে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েক পুলিশ ও কর্মচারী। কেউ কেউ অপেক্ষমাণ রুমে অবস্থান করছেন তথ্য জানার জন্য। এ সময় নিজ উদ্যোগে একজন এসে বললেন, তিনি পারবেন তাদের ভোগান্তি দূর করতে। কয়েকজনকে আলাদা করে বললেন, কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে তাকে দিতে হবে কিছু টাকা। সমস্যা সমাধানের আশায় তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জানা গেল দুই হাজার টাকা করে দিলে সমস্যা মিটে যাবে।

ভুক্তভোগী হিসেবে সেই সাহায্যকারীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, তার নাম মোবারক হোসেন বাদল। তিনি নিজেকে ‘মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের সভাপতি’ বলে দাবি করেন। কিন্তু বাস্তবে এ নামে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে তিনি এখানে দালাল হিসেবে কাজ করেন।

তিনি আরও জানান, প্রতিদিনই মন্ত্রণালয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোনো ধরনের সহায়তা করে থাকেন। কারণ মন্ত্রণালয়ের অনেক বড় বড় কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্য আছে। তবে তার বিনিময়ে খুব সামান্য টাকা দিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি তো খুব অল্প টাকায় কাজ করি। মন্ত্রণালয়ের লোকদের এর থেকে বেশি টাকা দিতে হয়।

পরের দিন টাকা নিয়ে এলে কীভাবে যোগাযোগ করব জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা সবাই আমাকে চেনেন। টাকা আর আবেদনের স্লিপ নিয়ে দেখা করার পর বিস্তারিত কথা বলবেন বলে জানান তিনি। এর পর অন্য ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

একইভাবে তিন মুক্তিযোদ্ধাকে সমস্যার ভয়াবহতা বোঝাচ্ছিলেন মান্নান নামে এক ব্যক্তি। এ প্রতিবেদক নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার নাতি পরিচয় দিয়ে নাম সংশোধনের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনিও বাদলের মতো একই কথা বলেন।

একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা যায় বুধবার বিকাল ৩টায়। অপেক্ষমাণ রুমের এক কোণায় বসে আছেন সাদা শার্ট পরা মো. মারুফ। তিনিও কয়েকজনকে নিজ উদ্যোগে সহায়তা করছেন। সেখানেও ভুক্তভোগী হিসেবে কথা বললে তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের সেক্রেটারি। প্রতিদিন বিকালেই এখানে আসেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লোকদের সহায়তা করার জন্যই আসেন। একই সঙ্গে তিনি কয়েকজনকে দেখান। তারাও একই কাজ করেন। তবে তাদের থেকে তার কাজ করার ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ কম।

কিছুক্ষণ কথা বলার পর সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি বলেন, আমি এখনো সেক্রেটারি হইনি। সামনে নির্বাচন করব। এমনিতেই প্রতিদিন এসে এখানে বসে থাকি।

এসব চিত্রের পর কথা হয় কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে। তারা জানান, মন্ত্রণালয়ে তাদের কাজ আছে বলেই এসেছেন। তবে নিজেদের নাম বলতে চান না। অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, একটি কাজের জন্য মাসের পর মাস বসে থাকতে হয়। কবে হবে তাও বলে না কেউ। তাই বাধ্য হয়েই তাদের টাকা দিয়ে কাজ করাতে হয়।

মন্ত্রণালয়ে কোনো কর্মকর্তাকে টাকা দিতে হয় কিনা জানতে চাইলে গাজীপুর থেকে আসা সাবিহা বেগম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমাদের দেশে কাজ করাতে কোথায় টাকা দেওয়া লাগে না। টাকা ছাড়া কোনো কাজই হয় না। সপ্তাহে একদিন আসি। তাও কাজ হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই টাকা দিই। টাকা দিলে একটু তাড়াতাড়ি কাজ হয়।

গত রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, টাকা দিয়ে কাজ করানোর নানা নজির পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় আক্ষেপ করে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, দেশকে পাকিস্তানি নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম। অন্যায় আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত দিতেও কার্পণ্য করিনি। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে আমরাই স্বাধীন দেশে শিকার হচ্ছি সেই অনিয়মের। টাকা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কোনো কাজই হচ্ছে না। এমনকি মন্ত্রী সুপারিশ করে দিলেও সেই কাজ সমাধান হতে লেগে যায় মাসের পর মাস। কিন্তু এসব বীরসন্তানই জিম্মি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গুটিকয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দালাল সিন্ডিকেট। দুই হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে এসব সিন্ডিকেট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজ করে দেয়।

মন্ত্রণালয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় দেখা মেলে এমন বেশ কিছু দালালের। তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধাভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী পরিচয় দিয়ে টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেন। মন্ত্রণালয়ের নিচেও দেখা যায় দালালদের আধিপত্য। অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আশ্রয় নেন এসব দালালের কাছে। আর দালালরা টাকার বিনিময়ে সেই কাজ করে দিচ্ছেন অতিদ্রুতই।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন কাজে এক হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধা আসেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ে আসছেন তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য দাখিলকৃত আবেদনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া, প্রত্যয়নপত্র, সাময়িক সনদ, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্লট, ফ্ল্যাট প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে সনদ যাছাই, ভুল সংশোধনসহ নানা কাজে আসেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এসব মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেন। আক্ষেপ করে মুজিবুর রহমান নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, অনেক কর্মকর্তা এমন ব্যবহার করেন যেন আমরা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে পাপ করেছি। রুম থেকে তাড়িয়ে দেন। গেজেট শাখার রুম কখনই খোলা পাওয়া যায় না। নামমাত্র একটি হেল্প ডেস্ক থাকলেও তা ১১টা থেকে মাত্র ১টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

দালাল কেন ধরতে হয় এমন প্রশ্নে একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানান, যেসব রুমে কাজ হয় সেই সব রুমের দরজা বন্ধ থাকে। চাইলেই কেউ রুমে প্রবেশ করতে পারে না। তাই বাধ্য হয়েই দালালদের কাছে যেতে হয়। এ ছাড়া কার কাছে গেলে কাজ করা যাবে, তাও কেউ বলেন না।

ভুক্তভোগীদের কথা মতো মন্ত্রণালয়ের হেল্প ডেস্কের রুমের সামনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কারো সঙ্গে একটি কথা বলারও সুযোগ ঘটেনি প্রতিবেদকদ্বয়ের। তবে রুমের বাইরে থেকে যারা রুমের ভেতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ফোন দিয়ে ডাকতে পারছে তারাই কেবল রুমে প্রবেশ করতে পারছে। তাই কথা না বলেই চলে আসতে হয় হেল্প ডেস্কের সামনে থেকে।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আমার রুম সব সময় খোলা থাকে। তাই কারো যখন কোনো সমস্যা হবে তারা সরাসরি আমার কাছে চলে আসবেন।

বেশিরভাগ রুমে ভুক্তভোগীরা কথা বলার সুযোগ পায় না এমন অভিযোগের পরিপ্রক্ষিতে মন্ত্রী জানান, প্রতিদিন তাদের এত কাজ করতে হয়। তাই কখনো কখনো রুমের দরজা বন্ধ করে রাখে তারা।

আর মন্ত্রণালয়ের দালালচক্র সম্পর্কে তিনি জানান, মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। কাজ না বুঝলে সহায়তা করা হয়। তার পরও যদি কেউ তাড়াতাড়ি কাজ করানোর জন্য দালালদের টাকা দেন তা হলে আমাদের কী বলার আছে।

সূত্র : আমাদের সময়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়