শিরোনাম
◈ গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল ◈ পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার ২৭ বস্তা টাকা, গণনা চলছে ◈ তীব্র তাপপ্রবাহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও ৭ দিন বন্ধের দাবি ◈ সাতক্ষীরায় এমপি দোলনের গাড়িতে হামলা ◈ চুয়াডাঙ্গার পরিস্থিতি এখন মরুভূমির মতো, তাপমাত্রা ৪১ দশমিক  ৫ ডিগ্রি ◈ ফরিদপুরে পঞ্চপল্লীতে গণপিটুনিতে ২ ভাই নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১ ◈ মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী ◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ প্রার্থী নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, হস্তক্ষেপ করবো না: পলক

প্রকাশিত : ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১০:০২ দুপুর
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১০:০২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বড় আতঙ্ক বনদস্যু

ডেস্ক রিপোর্ট : সুন্দরবনের মৎস্যজীবী, কাঁকড়া শিকারি কিংবা মধু ও গোলপাতা আহরণকারীরা চারপেয়ে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পান দুপেয়ে বাঘতুল্য বনদস্যুদের। জলদস্যুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে সংঘবদ্ধ বনদস্যুদের তাবৎ অপকর্ম। হামলা, হয়রানি, চাঁদাবাজি ও অপহরণকা- থেকে আপাত মুক্ত থাকতে বনদস্যুদের কাছ থেকেও টোকেন সংগ্রহ করতে হয় গহিন বনে আসা জেলে, মৌয়াল, বাওয়ালি ও কাঁকড়া শিকারিদের। মাথা পিছু ১০-৩০ হাজার টাকা দিয়ে দস্যু-টোকেন না নিলে যখন-তখন অপহরণের শিকার হচ্ছেন তারা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, সংঘবদ্ধ এসব দস্যু দল বনের সীমানা ছাড়িয়ে এখন লোকালয়েও ঢুকে পড়েছে; বাড়িঘর থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে হতদরিদ্রদের।

জানা গেছে, জীবিকার প্রয়োজনে বনে প্রবেশ করে দস্যু-টোকেন না থাকায় গত এক মাসে অপহৃত হয়েছেন ৪০ জনেরও বেশি বনজীবী। বনে ছোট-বড় দুই ডজনের মতো দস্যু দল সক্রিয় থাকলেও চাঁদাবাজি, অপহরণ ও নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় বনজীবীদের কাছে এখন মূর্তিমান আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বনদস্যু জোনাব, বড়ভাই ও মুন্না বাহিনী। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী দুবলারচর ও সুন্দরবনের উত্তর ও পশ্চিমের কয়েকটি এলাকায় বসবাসকারী বনজীবী ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

তারা জানান, গত ৩ ডিসেম্বর সুন্দরবনের হরমাল ও চরাপেটুয়া এলাকা থেকে দস্যুরা শরণখোলার দক্ষিণ রাজাপুর মাঝেরচর গ্রামের নাছির তালুকদারসহ ৭ জেলেকে অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা পণ দাবি করে। সেদিনই উত্তর রাজাপুর গ্রামের সরোয়ার মুক্তিপণের ৩০ হাজার টাকা ও মোড়েলগঞ্জের গুলিশাখালী গ্রামের এক জেলে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে বনদস্যুদের বন্দিদশা থেকে আহতাবস্থায় ছাড়া পান। গত ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর শরণখোলা রেঞ্জের বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন ছাপড়াখালী ও চাঁদপাই রেঞ্জের কলামুলা এলাকা থেকে ওই দুই জেলেসহ ২০ মৎস্যজীবীকে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে বনদস্যু সুমন বাহিনী ও ছোট্ট বাহিনী। দস্যুদের হাতে জিম্মি অন্য জেলেদের এখনো খোঁজ মেলেনি।

নিজেদের কোস্টগার্ড পরিচয় দিয়ে গত ৯ নভেম্বর রাতে সুন্দরবনসংলগ্ন উত্তর বেদকাশির হরিহরপুর গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে মৎস্য ব্যবসায়ী জ্যোতিষ মাহাতোকে অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে বনদস্যু ফারুক বাহিনীর ৮ সদস্য। অপহরণকালে পালিয়ে আসার সময় দস্যুদের গুলিতে আহত হন জ্যোতিষ মাহাতোর ছোট ভাই ধীরেশ মাহাতো। ঘটনার ৮ দিন পর সুন্দরবনের কয়রা বন টহল ফাঁড়িসংলগ্ন মঠের খাল এলাকায় বনদুস্যদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর অপহৃত জ্যোতিষ মাহাতোকে উদ্ধার করে কয়রা থানাপুলিশ। পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকা থেকে বনদস্যু নুর-এ-আলম বাহিনীর হাতে অপহৃত ১৭ জেলেকে গত ৮ নভেম্বর রাতে সুন্দরবন মালঞ্চ নদীর পাটের ভাড়ানি খাল থেকে উদ্ধার করে র্যাব-৬। দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয় দুই দস্যুকে। ৩১ আগস্ট বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের ককিলমনি শেলারচর এলাকায় বন্দুকযুদ্ধের পর বনদস্যু বড় ভাই বাহিনীর সদস্যদের জিম্মিদশা থেকে অপহৃত ৬ জেলেসহ ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। মুক্তিপণের দাবিতে এভাবে প্রায় প্রতিদিনই বনদস্যুদের হাতে অপহৃত হচ্ছেন অসহায় বনজীবীরা। দস্যুদের পণের টাকা দিয়ে কেউ ফিরে এসেছেন, আবার অনেকে এখনো জিম্মিদশায় রয়েছেন।

বনজীবীরা জানান, প্রতিবছরের পহেলা এপ্রিল (বাংলাÑ১৮ চৈত্র) থেকে ২-৩ মাসের জন্য মধু আহরণের অনুমতি পান মৌয়ালরা। গোলপাতা আহরণের সুযোগ থাকে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস পর্যন্ত। প্রজননের কারণে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে কাঁকড়া আহরণ করার অনুমতি মেলে না জেলেদের। নির্ধারিত সময়ে মাছ-কাঁকড়া শিকার ও মধু-গোলপাতা আহরণ করতে যাওয়ার আগে জেলে ও বনজীবী প্রকারভেদে এককালীন ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে দস্যুদের কাছ থেকে টোকেন নিতে হয়। টোকেন হিসেবে চাঁদা প্রদানকারী বনজীবীকে ১০ বা ৫০ টাকার একটি নোট দেওয়া হয় দস্যুদের পক্ষ থেকে। এটি বনজীবী ও জেলেদের সঙ্গে রাখতে হয়। নোটটিতে যে নম্বর থাকে, সেই নম্বরটি বনজীবীর নামসহ লিপিবদ্ধ থাকে দস্যুদের কাছেও। ওই নোটটি দেখানো হলে দস্যুরা মিলিয়ে দেখে তাদের তালিকার সঙ্গে। টাকার নম্বর তালিকার সঙ্গে মিলে গেলে ওই বনজীবীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ টোকেন এক মৌসুম মেয়াদি। যে মৌসুমের জন্য টোকেন দেওয়া হয়, সে মৌসুমে ওই বনজীবী সংঘবদ্ধ দস্যুদের হামলা, হয়রানি, চাঁদাবাজি ও অপহরণ থেকে আপাত মুক্ত থাকেন।

তারা আরও জানান, পূর্ব সুন্দরবন অপেক্ষাকৃত কম দুর্গম। সেই তুলনায় দক্ষিণ-পশ্চিম সুন্দরবন গহিন অরণ্যে ঘেরা দুর্গম অঞ্চল। সেখানকার কোনো কোনো স্থানে ট্রলারে চেপে পৌঁছতেও দিন দুয়েক সময় কেটে যায়। এমনই দুর্গম অঞ্চলেও ঘাঁটি গেড়েছে বনদস্যুর দল। অত্যাধুনিক নৌযান আর অস্ত্র-গোলাবারুদে সজ্জিত এসব বাহিনীর প্রধান টার্গেট নিরীহ জেলে, মৌয়াল, বাওয়ালি, কাঁকড়া শিকারিরা। এ ছাড়া ভারত থেকে মাদক-অবৈধ জিনিসপত্রের চালান পৌঁছে দেওয়ার কাজেও সিদ্ধহস্ত এসব বাহিনীর সদস্যরা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সুন্দরবন বিভাগ ও জেলে-বাওয়ালি-মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পূর্ব ও পশ্চিম সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জ (বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলা, পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা) এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুই ডজন বনদস্যু বাহিনী। চলতি শুঁটকির মৌসুম ও আসন্ন গোলপাতা সংগ্রহের মৌসুমকে টার্গেট করে দস্যুতায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন বাহিনীও। স্থানীয় ছোটখাটো গ্রুপও আছে যারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে চড়াও হয় বনজীবী ও জেলেদের ওপর।
সুন্দরবনের ক্রাইম জোনের নিয়ন্ত্রণ এখন মূলত বনদস্যু মাথাকাপা জোনাব, বড় ভাই ও মুন্না বাহিনীর হাতে। সুন্দরবনের গেড়া, চালকি, মার্কি ভোমরখালি, হংরাজ, বয়ারসিং, কঞ্চি, বজবজা, খাসিটানা, আড় পাংগাসিয়াসহ পূর্ব বন বিভাগের অন্যান্য খাল এবং নদী ছাড়াও বনের ভেতর একছত্র আধিপত্য তাদের। এ ছাড়া ওইসব এলাকায় ফারুক, সুমন, ছোট্ট রাজু, রফিকুল বাহিনীর অপতৎপরতাও কম নয়। অন্য বাহিনীগুলো হলোÑ আমজাদ বাহিনী, জুলফিকার আলী গামা বাহিনী, ফরহাদ বাহিনী, শহিদুল বাহিনী, নাসির বাহিনী, জিহাদ বাহিনী, জাকির বাহিনী, রুবেল বাহিনী, বাকিবিল্লাহ বাহিনী, মাহবুব বাহিনী, তছলিম বাহিনী, মুর্তজা বাহিনী, আনোয়ার বাহিনী, দুই ভাই বাহিনী ও রেজাউল ওরফে শীর্ষ বাহিনী। এসব বনদস্যু বাহিনীর সদস্যদের চাঁদা না দিয়ে মাছ-কাঁকড়া শিকার ও মধু-গোলপাতা সংগ্রহ করতে পারেন না জেলে ও বনজীবীরা। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে এসব বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য ধরা পড়েছে। কেউবা মারা পড়েছে বন্দুকযুদ্ধে। সরকারের কাছে আত্মসমর্পণও করেছে কয়েকজন।

জানা গেছে, গত ৭ নভেম্বর সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি খালে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় দস্যু জোনাব বাহিনীর উপপ্রধান নান্নু মোল্যা। ১০ জুন দুপুরে গভীর সুন্দরবনের হড্ডা এলাকায় র্যাব ৬-এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় বনদস্যু রবিউল বাহিনীর প্রধান রবিউল। ৭ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীসংলগ্ন মৃগমারী এলাকায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় বনদস্যু শামসু বাহিনীর প্রধান শামসু ওরফে কোপা শামসু।
র্যাব সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত (২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর) বনদস্যু দমনে ৭২টি অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। এ সময়কালে গ্রেপ্তার হয় ৬৬ বনদস্যু; উদ্ধার হয় ৩০৩টি আগ্নেয়াস্ত্র; জব্দ করা হয় ৭ হাজার ৮৪৩ রাউন্ড গোলাবারুদসহ ২৪টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র। এ সময় বনদস্যুদের বিরুদ্ধে করা মামলার সংখ্যা ৮১টি। এদিকে ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বিভিন্ন বাহিনীর একাধিক দলনেতাসহ ৫৮ বনদস্যু।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বনদস্যুদের নির্যাতনের কারণে প্রতিবছর জেলের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কয়রা উপজেলার ৩ স্টেশনে বিগত বছরে কাঁকড়া ও মাছ ধরা জেলের সংখ্যা ছিল ৬-৭ হাজার, যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজারে। দস্যুদের ভয়ে কমে যাচ্ছে মৌয়াল ও গোলপাতা আহরণকারীদের সংখ্যাও। আমাদের সময়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়