শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু, মানতে হবে কিছু নির্দেশনা ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা

প্রকাশিত : ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৬:১৩ সকাল
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৬:১৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

জনগণ কী সেই ম্যান্ডেট দিয়েছে?

লীনা পারভীন : চিরকালের এক চমৎকার শ্লোগান হচ্ছে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু বাংলাদেশের এই মুহূর্তের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে সেই মেরুদণ্ড শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছে তো? ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় এবং একটি জাতি গঠনে শিক্ষার ভূমিকার কথা নতুন করে বলার কিছু নাই। এসব পাঠ্যপুস্তকের মাঝেই স্বীকৃত বিষয়। একটি জাতির সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সব কিছুই নির্ভর করে একটি সঠিক, আধুনিক ও বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর।

স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও আমরা একটি স্থিতিশীল ও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা নীতি পাইনি। বর্তমান সরকার শিক্ষা নীতির কাজে হাত দিয়েও খুব একটা এগুতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না। রাষ্ট্রের চরিত্রের উপর নির্ভর করে শিক্ষা নীতিটি কোন বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে। আমাদের দেশে বর্তমানে বহুমুখী শিক্ষা পদ্ধতি চালু আছে। এর সাথে আবার সমাজের শ্রেনীভিত্তিক চেতনার একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে।

সরকারী বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা দিনে দিনে নাম সর্বস্ব হয়ে থাকছে। ইংরেজী ও মাদ্রাসা এই দুই মাধ্যমেই আছে চূড়ান্ত রকমের বৈষম্যের ছাপ। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতি, প্রস্তুতি সব কিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সেখানে নেই আধুনিকতার ছোঁয়া। যুগের পরিবর্তন হলেও সিলেবাস থেকে শুরু করে শিক্ষা দানের পদ্ধতির কোন পরিবর্তন হয় না। অথচ আমরা গ্লোবাজাইশেনে বিশ্বাস করি।

আমাদের প্রাথমিক থেকে শুরু করে সকল স্তরেই এখনও মান্ধাতা আমলের পাঠ্যক্রম, পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। সেসবের কিছু কিছু জায়গায় আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিলেও তার সবটাই রয়ে গেছে জগাখিচুড়ির মত। নেই আধুনিক শিক্ষক, নেই প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা, নেই মানসিকতার পরিবর্তন। এতো গেলো কাঠামোগত কথাবার্তা।

কিন্তু এই প্রচলিত ব্যবস্থার মাঝেও আমাদের ছাত্ররা যা শিখছে তার কত অংশ তাদের বাস্তব জীবনের কাজে লাগে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। তার সাথে যুক্ত হয়েছে পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক। প্রাথমিক পর্যায়ের সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট এই দুটি আমাদের সন্তানের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেখানে প্রবর্তন করা হয়েছে বোর্ড কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা পদ্ধতি। আগের যে বৃত্তি পরীক্ষা পদ্ধতি ছিলো সেটা ছিলো সংকীর্ণ এবং কিছু নির্বাচিত ছাত্রের জন্য নিজেকে প্রমাণের সুযোগ।
কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে ঠিক করা হলো একটি প্রতিযোগীতামূলক ব্যবস্থার। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ দুটি পরীক্ষা শুরু হলেও প্রায়োগিক এবং বাস্তবতার নিরিখে এর কার্যকারিতা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক বা মতামত। উদ্দেশ্যকে যদি মহতও ধরে নেই তাহলে প্রশ্ন আসে এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশুরা একটি বড় পরিসরের পরীক্ষা দেয়া ছাড়া আর কী অভিজ্ঞতা অর্জন করছে যা তাকে সামনের দিনে আরও প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে সাহসী করে তুলবে।

পক্ষে বিপক্ষে মতামতের মাঝেই শুরু হয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের মত এক নতুন অপরাধমূলক কার্যক্রমের। প্রশ্নফাঁস এতদিন কেবল এস এস সি/এইচ এস সি পর্যায়ে বা অতি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতে প্রচলিত থাকলেও তার আগমন ঘটেছে কোমলমতি বাচ্চাদের পরীক্ষাতেও।

অথচ আমরা দেখছি শিক্ষা মন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাকে কখনও মিথ্যা বা কখনও অতিরঞ্জিত বলে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সারা দেশ যখন এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোর জন্য যখন ক্রমাগত পাবলিক প্রেসার বেড়ে চলেছে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা ততই যেন এটিকে অস্বীকার করে পার পেতে চাইছেন।

ফলাফল, আমাদের ছেলেমেয়েদের মাঝে এখন পড়ালেখা করার আগ্রহ কমে গিয়ে প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকার প্রবণতার জন্ম নিয়েছে। বাচ্চাদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও এখন নিজের বাচ্চা যেন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে সেই চেষ্টায় যোগ দিচ্ছেন এই অপরাধের সাথে।

পত্রপত্রিকায় প্রমাণ সহ ঘটনার বিবরণ ছাপা হলেও তা অস্বীকার করার যে রাজনীতি আমাদের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তারা করতে চাইছেন তারা কী একবারও ভেবে দেখছেন কত বড় সর্বনাশ তারা করে চলেছেন এই বাংলাদেশের? এই ক্ষতি ৭১ এ পাকিস্তানী হানাদারদের ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনার যে উদ্দেশ্য তার থেকে খুব বেশী পার্থক্য করার উপায় আছে কী? পাকিস্তানীরা বুলেটের মাধ্যমে আমাদের জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিলো আর আজকের শিক্ষামন্ত্রী ও তার বাহিনী করতে চাইছেন ব্যালটের মাধ্যমে।

ক্ষমতায় থাকলেই যা ইচ্ছা তা করা যায় না এ কথাটি যেন ভুলতে বসেছেন আমাদের মন্ত্রনালয় ও বোর্ডের নেতারা। সবাই আছে যার যার আখের গোছানোর ধান্দায়। প্রশ্ন ফাঁসকে ঠেকাতে এখনও পর্যন্ত জাতি কোন কার্যকর পদক্ষেপ পায়নি যা দেখে আমরা আশান্বিত হতে পারি। কী অসহায় আমরা। উনাদের হাতে ক্ষমতা আছে বলেই আজকে আমাদেরকে জিম্মি করে ফেলতে চাইছেন। আর আমরা জনগণ কেবল আস্ফালন করেই মরলাম।

এই যে ছোট ছোট বাচ্চারা বুঝতে শিখেই শিখছে বাংলাদেশে চুরি করা কোন অন্যায় নয়। একদল শিখছে ক্ষমতার সাথে যোগ থাকলেই হওয়া যায় ক্ষমতাবান। অন্যায় করলেও নেই কোন শাস্তি। প্রশ্ন ব্যবসার সাথে যুক্ত করে হওয়া যায় রাতারাতি পয়সাওয়ালা। আবার আরেকদল শিখছে, রাতদিন গাধার মত পড়াশোনায় কোন ফায়দা নেই। তার চেয়ে পরীক্ষার আগের রাতে রেডিমেড প্রশ্ন ও উত্তরের জন্য প্রস্তুত থেকেই হাতে পাওয়া যায় মেধাবীর সার্টিফিকেট।

কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারছে না যে এই চুরি করা সার্টিফিকেটে ‘মেধাবী’ ট্যাগ হয়তো কেনা যায় কিন্তু জীবনের পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে এর থেকে কোন ফসল তুলে আনা যায় না। আর সেটা যখন টের পায় তখন আর শোধরানোর রাস্তা থাকে না। নেমে আসে হতাশা। সেই হতাশা ছেয়ে যায় পরিবার থেকে সমাজে। বেকারত্বকে নিয়তি মেনে সেইসব টাকায় বিক্রিত মেধাবীরা শুরু করে সমাজে নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম।

কত সহজে একটি জাতিকে মেধাশূন্য করে দেয়া হচ্ছে অথচ এর দায় কেউ নিতে রাজি নয়। প্রশ্ন ফাঁসের সাথে আছে ভুলভাল প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া। প্রশ্নপত্রে বানান ভুল থেকে শুরু করে আছে ভুলভাল ভাষায় প্রশ্ন সহ বিশাল বিশাল ভুলের তালিকা। প্রশ্নপত্র কারা করে জানা নেই। সেইসব প্রশ্নপত্র নিয়ে আছে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেবার মত গুরুতর অভিযোগও।

অর্থাৎ, প্রশ্নপত্রের মাঝে হয়তো কোন শিক্ষক বা একটি গোষ্ঠি ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে চান ছাত্রদের মাঝে। সৃজনশীলের নামে যে পদ্ধতি চালু আছে সেটি নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগ। স্কুলের শিক্ষকরা নিজেরাই জানে না সৃজনশীল প্রশ্ন কী বা কেমন করে করতে হয় সেখানে ছাত্রদের অবস্থা সহজে অনুমেয়। স্কুলগুলোতে বাৎসরিক যে সিলেবাস থাকতো আগে কিছু কিছু স্কুলে এখন আর সেই নিয়ম ফলো করা হচ্ছে না। এ যেন টোটাল এক অব্যবস্থার মাঝে দিয়ে এগুচ্ছে আমাদের গোটা শিক্ষাক্ষেত্র।

অথচ এ নিয়ে উচ্চমহলে খুব একটা চিন্তার কিছু দেখছি না। কয়দিন পর পর আমাদের শিক্ষা মন্ত্রী মহোদয় বিভিন্ন সভাসমাবেশে বুলি দিলেও সেসবের বাস্তব প্রতিফলন একেবারেই নেই। আমরা নাগরিকরা সরকারের শিক্ষা নিয়ে ‘ভিশন’ কী তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছি।

সরকারের অনেক উন্নয়নের সুফল আমরা জনগণ পেলেও জাতির এই মেরুদণ্ডকে শক্ত করতে তাদের ‘ভিশন’ খুব একটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না। যদি হয় কেবল পাসের হার বৃদ্ধি করা তাহলে বলতেই হয় সরকারের টার্গেটে গলদ আছে। গুণগত মানকে পরিহার করে কেবল সংখ্যাগত বৃদ্ধি কোন জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।

গোটা একটা ব্যবস্থাকে গড্ডালিকা প্রবাহের মাঝে ভাসিয়ে দিয়ে সরকারের টার্গেট পূরণের লক্ষ্যে যদি কোন কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাহলে সেখানে জনগণের ভোট কতটা আসবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার।

জনগণ কী আপনাদেরকে সেই ম্যান্ডেট দিয়েছে? যদি মনে করেন আপনারা জনগণের সরকার তাহলে কী একবার হলেও ভেবে দেখবেন, জাতির এই শিক্ষা নামক মেরুদণ্ডে যে ঘুণপোকাদের আপনি জন্ম দিয়েছেন এবং বছরের পর বছর ধরে তাদেরকে খাইয়ে পড়িয়ে বিস্তার ঘটাচ্ছেন সেখানে মেরুদণ্ড ক্ষয়ে যাচ্ছে কি না?

ক্ষয়ে যাওয়া মেরুদণ্ড নিয়ে আপনারা কোন বাংলাদেশকে বিশ্বের সাথে লড়াইয়ে নামতে বলছেন? আদৌ কী সম্ভব ঘিলু ছাড়া কোন জাতির পক্ষে সত্যিকার অর্থে মেধার লড়াইয়ে শামিল হওয়া? ঘুণে খাওয়া নড়বড়ে মেরুদণ্ডওয়ালা কোন জাতি কী মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, না পেরেছে কোনদিন?

লীনা পারভীন : কলাম লেখক ও সাবেক ছাত্রনেতা। পরিবর্তন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়